শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা এবং সীমাবদ্ধতা
ড. গৌতম সাহা
প্রকাশ: শুক্রবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১, ৬:০৩ পিএম আপডেট: ৩১.১২.২০২১ ৬:১৪ পিএম | অনলাইন সংস্করণ

২১ শতকের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যেখানে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক সাফল্যকে এত বেশি গুরুত্বের সাথে দেখা হয় যে উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের একাডেমিক অগ্রগতি মূল্যায়নে অনেকটা সময় দিয়ে থাকে। এই মূল্যায়ন পদ্ধতি সারা বিশ্বে একই রকম নয়। বরং কোনো কোনো দেশে এই মূল্যায়ন পদ্ধতি অনেক কঠিন ও জটিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সংবাদপত্রে প্রতিনিয়ত লেখা প্রকাশিত হচ্ছে, এবং অধিকাংশ লেখাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোথায় কোথায় ভুল হচ্ছে সেই বিষয়ক। এতে একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে, উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অথচ, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলো কি কি সেটা খুঁজে বের করাও গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আমি সেই সমস্যা গুলির কয়েকটি তুলে ধরছি।

শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব: আমাদের দেশে একজন শিক্ষার্থী তার ছাত্রজীবন শেষ করার পরপরই শিক্ষকতা করার সুযোগ পান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর তাকে কোনো ধরণের প্রশিক্ষণের সুযোগ না দিয়েই শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করতে বলা হয়। অথচ একজন ভালো শিক্ষক গড়ে তোলার জন্য প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই।

শ্রেণীকক্ষে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী: ক্লাসরুমে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ১:৩০ থাকা উচিত, কিন্তু আমাদের শ্রেণীকক্ষে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী থাকার জন্য শিক্ষকদের পক্ষে প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের প্রতি আলাদা করে মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। গবেষণায় দেখা গেছে, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত শিক্ষার্থীদের একাডেমিক সাফল্যের  অন্যতম শক্তিশালী মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

শিক্ষকদের অপ্রতুল বেতন: ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা সহ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনের সাথে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনের তুলনায় এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনেক কম বেতন এবং সীমিত সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন, যা শিক্ষার মানউন্নয়নে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষকরা তাদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না দেখে হতাশ এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের তাগিদে শিক্ষা বিমুখ।

উচ্চ শিক্ষায় গবেষণার জন্য তহবিলের অভাব: বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ খুবই সীমিত। সামগ্রিক চিত্র যদি তুলে ধরি তাহলে দেখা যাবে, কিছু সংখ্যক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের মোট বাজেটের আনুমানিক ১% ব্যয় করেছে গবেষণায়, অন্যদিকে কিছু সংখ্যক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় ক্ষেত্রে ব্যয় করেছে তাদের মোট বাজেটের আনুমানিক ২% এবং কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য বরাদ্ধ খুবই নগন্য।
শিক্ষার্থীদের প্রতি পিতা-মাতার উৎসাহের অভাব: অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা নিজের পছন্দের বিষয়ে পড়াশুনা করতে চেয়েও শুধুমাত্র পিতা-মাতার সমর্থনের অভাবে সেই বিষয়ে পড়তে পারে না। এমনকি, শিক্ষা জীবনে পিতা-মাতার উৎসাহের অভাবে একজন শিক্ষার্থী আশানুরূপ ফলাফল করতে ব্যর্থ হয়।

শিক্ষার্থীদের জন্য অপরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা: অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো আবাসন ব্যবস্থা নেই, আবার অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে তা নিয়েও অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। একটি সিটের বিপরীতে একাধিক ছাত্রকে থাকতে হচ্ছে, খাবারের মান নিম্মমানের, থাকার পরিবেশ অপরিচ্ছন্ন, এবং হলগুলোতে ছাত্র রাজনীতির প্রভাব।

এছাড়াও, আরো অনেক সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে কয়েকটি হলো, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য তহবিলের অভাব; অপর্যাপ্ত শ্রেণীকক্ষ সুবিধা ও শিক্ষা উপকরণ; শ্রেণীকক্ষে প্রযুক্তিগত সুযোগসুবিধার অভাব; অনেক শিক্ষকের শিক্ষার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থতা; শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণার অভাব; সেকেলে পরীক্ষা পদ্ধতি; প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সুযোগ সুবিধার অভাব; অনেক ক্ষেত্রে পাঠ্যক্রম যুগোপযুগী নয়; শিক্ষকদের দ্বারা ছাত্রদের মাঝে কৌতূহল এবং সহযোগিতামূলক শিক্ষাকে উৎসাহিত করার কৌশল এবং পদ্ধতিগুলি আয়ত্ত করার ব্যর্থতা।

যদি এই সমস্যাগুলোকে সমাধান করার উদ্যেগ না নেয়া হয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষা ভয়াবহ সংকটে পড়বে। আমরা শিক্ষার্থীদের এখন যেভাবে প্রস্তুত করছি তাতে করে তারা কর্ম জীবনে পেশাগত কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না, অধিকাংশ শিক্ষার্থী আশানুরূপ ফলাফল করতে ব্যর্থ হচ্ছে, আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি ছাত্রদের কর্মক্ষমতা নিরুপন করতে ব্যর্থ হচ্ছে, আমরা উচ্চশিক্ষার এমন একটি রূপ দেখতে পাচ্ছি যা প্রকৃতপক্ষে বিষয় জ্ঞান বা নিয়োগ যোগ্যতা দক্ষতার সাথে সম্পর্কিত নয়। পড়াশুনা একটি নিয়মিত চর্চার বিষয় যেখানে আপনি প্রতিনিয়ত শিখবেন এবং আপনার শেখার পরিধি বিসৃত করবেন। আমাদের অনেক শিক্ষার্থী শুধু মাত্র আমাদের মুখস্ত করা পরীক্ষা পদ্ধতির জন্য আশানুরূপ ফলাফল করতে পারছে না, এবং হারিয়ে যাচ্ছে। 

পৃথিবী বদলে যাচ্ছে এবং এর সঙ্গে বদলে যাচ্ছে শিক্ষন পদ্ধতি। আমাদের সময়ের সাথে প্রয়োজন অনুসারে একটি যুগোপযুগী শিক্ষন পদ্ধতি পরিকল্পনা করতে হবে যা আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতার দিকে মনোনিবেশ করার মানসিকতা তৈরী করতে হবে। আমাদের উচ্চশিক্ষা আর গবেষণার মানোন্নয়নে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে, আরও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। আমাদের উচিত শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যের দিকে মনোযোগ দেওয়া, অর্থ হলো, জীবনের চ্যালেঞ্জের জন্য আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করা, আমাদের একটি যুগোপযুগী পাঠ্যক্রম দরকার, যা শিক্ষার্থীদের একজন ভালো মানুষ হতে সাহায্য করবে এবং কর্মজীবনে তাদের সাফল্য পেতে সহায়তা করবে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।






ডেল্টা টাইমস্/ড. গৌতম সাহা/সিআর/আরকে



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬১, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬১, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com