অস্থিতিশীল পরিবেশ অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কা
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
দেশের ছাত্র-জনতার ২৩ দিনের ঘটনাবহুল আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক মাস পূর্ণ হয়েছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। তবে নানা ঘটনায় আন্দোলনের রেশ এখনো পুরোপুরি কাটেনি। প্রশাসন, পুলিশসহ নানা প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের মাধ্যমে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সরকার চেষ্টা অব্যাহত রাখলেও দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো সেভাবে দৃশ্যমান নয়।আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালন করা হয়নি। ওই দিন প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা থাকলেও ছাত্র-জনতা তা রুখে দেয়। এখনো বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে। তবে গত এক মাসে গোপালগঞ্জ ছাড়া দেশের অন্য কোথাও প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের কোনো আন্দোলন চোখে পড়েনি।শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে তাঁর টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণের বিপুল ভোটে ক্ষমতায় বসেছিলেন তিনি। এরপর নিজের শাসনামলে আর কোনো গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন দিতে পারেননি তিনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এতে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েই ছিল। সেটির বহিঃপ্রকাশের জন্য শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল। উপলক্ষ তৈরি করে দেয় সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। নতুন প্রজন্ম যে বাংলাদেশ চায় সবাইকে সেই বাংলাদেশকে স্বাগত জানাতে হবে। আমরা একটি আইনের শাসনের দেশ চাই। যাঁরাই জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন তাঁদের ছাড় দেওয়া হবে না। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর মানবাধিকার লঙ্ঘন, ব্যাপক দুর্নীতি ও অর্থপাচার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা, ঋণের নামে ব্যাংক লুটের সুযোগ দেওয়া, আয়বৈষম্য চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াসহ বিগত সরকারের বিস্তৃত কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সংস্কারমূলক কাজ শুরু করেছে। বিদায়ী সরকারের বিভিন্ন অপকর্মের জন্য সারা দেশে সিন্ডিকেট তৈরি করেছিল। এর মধ্য দিয়ে দেশকে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অনেক জায়গায় এখনো এসব সিন্ডিকেট চলছে। অনেক জায়গায় শুধু মাথা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সিস্টেম একই রয়ে গেছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম মাধ্যম তৈরি পোশাক শিল্প খাত। কিন্তু গত মাসের মাঝামাঝি থেকেই খাতটি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। পোশাক শিল্প-কারখানায় শ্রমিকদের বিক্ষোভ নতুন নয়। বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভের জেরে শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আলোচনার ভিত্তিতে তা সমাধানও করা হয়েছে। কিন্তু এবার পোশাক খাতে শুধু নারী নয় সমান সংখ্যক পুরুষ কর্মী নিয়োগ, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, হাজিরা বোনাস প্রদান এবং আন্দোলনকারী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়াসহ ১১ দফা দাবিতে আন্দোলনের সূত্রপাত। এ আন্দোলন শিল্পাঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সরকার, শ্রমিক ও মালিকপক্ষ দফায় দফায় আলোচনা করেও এ খাতে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারছে না। ফলে নিরাপত্তার অভাবে বাধ্য হয়ে মালিকপক্ষ সাধারণ ছুটিসহ অনির্দিষ্টকালের জন্য পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করছে। এ অস্থিতিশীলতার কারণে এ খাতের উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। পোশাক শিল্প মালিকরা ক্রেতাদের চাহিদামতো যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ করতে পারছেন না। ফলে ক্রেতারা তাদের ক্রয়াদেশ বাতিল করছেন। এরই মধ্যে ১৫-২০ শতাংশ ক্রয়াদেশ বাতিল করা হয়েছে। এ খাতে অস্থিতিশীল পরিবেশ দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেই মঙ্গলজনক নয়। এ ধরনের অস্থিরতার কারণে বিদেশী ক্রেতাদের কাছে এ খাতের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। চলমান অস্থিরতা পোশাক খাতকে ধ্বংসের পাশাপাশি রফতানি আয়কে প্রভাবিত করছে, যা দেশের অর্থনীতিকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলছে। সরকারকে এ খাতে অস্থিতিশীলতা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি নিরপেক্ষ ভূমিকায় কাজ করতে হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পটপরিবর্তনে দেশে এ মুহূর্তে একটি নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পুলিশ ও প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের কাজ চলছে। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ খাতে এ ধরনের অস্থিতিশীলতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। শ্রমিক নেতারা বলছেন, ক্ষমতার পালাবদলে একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, ঝুট ব্যবসা ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে শিল্পাঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করছে। কারখানা গুলোয় নেতৃত্বের পালাবদল ও শ্রমিক সংগঠনের কমিটি গুলোয় নিজেদের কর্তৃত্ব নিতে পেছন থেকে ইন্ধন দিয়ে শিল্পকে অস্থির করার পাঁয়তারা চলছে। তাদের এ অভিযোগ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বেকার সমস্যা সমাধানে এবং অর্থনীতির বিকাশে এ খাতের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। এ খাতে অস্থিতিশীলতা যদি জিইয়ে থাকে তাহলে এর বিরূপ প্রভাব কতটা বহুমুখী হতে পারে তা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। তৈরি পোশাক শিল্প খাতে অচলাবস্থার অবসান যেকোনো মূল্যে করতেই হবে। সবার আগে মালিকপক্ষের যথাযথ ভূমিকা প্রয়োজন। শিল্পাঞ্চলে ভাংচুর, লুটপাট বন্ধে যূথবদ্ধ প্রয়াস চালানোর বিকল্প নেই। অনুকূল ব্যবসা পরিবেশ তৈরি করা সবার স্বার্থেই জরুরি। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হোক। ব্যক্তি বা মহলবিশেষের হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণের লক্ষ্যে অর্থনীতির জোগানদাতা এ খাতে অস্থিতিশীলতা জিইয়ে থাকুক তা শুভবোধসম্পন্ন কারোরই কাম্য হতে পারে না। কেননা উৎপাদন ব্যবস্থায় অভিঘাত লাগলে এ খাতের বহুমুখী বিরূপ প্রভাব যে দৃশ্যমান হয়ে উঠবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আশুলিয়া ও গাজীপুরে চলমান অস্থিরতার কারণে অর্ধশতাধিক কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। পোশাক শিল্পের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া, জিরানী, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা মেট্রোপলিটন ও চট্টগ্রাম এলাকায় মোট পোশাক কারখানা রয়েছে ২ হাজার ১৪৪টি। দেশে পোশাক খাত বিকশিত না হলে বেকার বহুগুণ বেড়ে যেত।নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়েও এ খাত এগিয়েছে। দেশের বিকাশমান এ শিল্পকে ধ্বংস করে যারা দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়ার আত্মঘাতী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে, তাদের দ্রুত চিহ্নিত করা দরকার। কেননা এ খাত ধ্বংস হয়ে গেলে দেশে বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না এবং বেকারত্ব বাড়বে। এ খাতের অস্থিতিশীতা শুধু অর্থনীতিকে মারাত্মক হুমকিতে ফেলবে না, বরং সংশ্লিষ্ট অন্য খাতগুলোর আয়ের পথও বন্ধ হয়ে যাবে। মোট কথা, যারা এ খাতকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারায় লিপ্ত তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।বিক্ষুব্ধ শিল্প এলাকায় সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব,পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। তবে তাদের তৎপরতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি শিল্প পুলিশকে কার্যকর করতে হবে। এছাড়া মালিক পক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে শ্রমিকদের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা। শ্রমিকদের শোষণ করে একচেটিয়া মুনাফা করার মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। পোশাক কারখানা চালু থাকার অর্থ অসংখ্য শ্রমিকের জীবনমানের ভিত শক্ত থাকা। তাই এ নিয়ে যেকোনো ষড়যন্ত্র, আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড দমনে কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে মোকাবেলা করতে হবে। মোটকথা বাংলাদেশের অর্থনীতি গভীর খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে বললে সম্ভবত অত্যুক্তি হবে না। অতি দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে। আমরা আশান্বিত যে প্রায় ভঙ্গুর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমেই উন্নতি ঘটছে এবং প্রথমবারের মতো নিয়োজিত বাহিনীর সঙ্গে তরুণরাও সক্রিয় হয়ে অবদান রাখছে। প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন কিংবা লাইনচ্যুত ট্রেন টেনে তোলা ইত্যাদি যা-ই বলি না কেন, এর পূর্বশর্ত হচ্ছে যথাযথ আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনা, যেখানে আইনের শাসন বলবৎ থাকবে, শাসনের আইন নয়। যেমন, লাগামহীন মূল্যস্ফীতি রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। অনেকের ধারণা, প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। এই মূল্যস্ফীতির পেছনে অন্যতম প্রধান চালক চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট। খুব ক্ষুদ্র উদাহরণ হলেও বাজারের কারসাজি তথা মূল্য নিয়ন্ত্রণে ছাত্রদের সাম্প্রতিক উদ্যোগগুলো কিভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যায় সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। নীতিনির্ধারকদের প্রথম কাজ হবে চাঁদাবাজি বন্ধ করা ও যথাযথ তদারকির মাধ্যমে বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে প্রতিযোগিতা মূলক পরিবেশ তৈরি করা। ব্যাংকিং খাতে যে লুটেরা শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছে-এক হিসাবে গেল দেড় দশকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা লোপাট-তাদের কুশীলবসহ আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সময়ের দাবি। একই কথা পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রেও সত্যি। মরা এবং খোঁড়া ব্যাংক জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বাঁচিয়ে লাভ নেই। আপাতত প্রবৃদ্ধির চিন্তা না করে আগে অর্থনীতির চাকা সচল করতে হবে-যা আছে, তা ঠিকমতো চলছে কি না, সেটি আগে নিশ্চিত করতে হবে। এবং সব শেষে দুর্নীতি এবং অর্থপাচার, বছরে প্রায় সাত বিলিয়ন ডলার, রোধে চলমান কিছু পদক্ষেপ বেগবান করা এবং নবধারামূলক উপায়ে দুষ্কৃতকারীদের আইনের আওতায় এনে অর্থ উদ্ধার করা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করা যায়।বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তা অর্জনে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থিতিশীলতা জরুরি। মোট কথা, আন্দোলনের নামে নিষ্ঠুরতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ছাত্র জনতার আন্দোলন ছিল যৌক্তিক। জনকল্যাণমূলক এই আন্দোলনে কমবেশি সবার সায় আছে। কিন্তু তাতে যুক্ত হয়েছে কুচক্রীমহল। তারা নানাভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করে ফেলছে। অর্থ ও পেশিশক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। এমনকি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার মতো নিষ্ঠুরতাও হচ্ছে। এতো এতো সমস্যা বা অভিযোগ সত্ত্বেও বলা যায়, বাংলাদেশে শান্তি বজায় রাখা সম্ভব। সরকারের পক্ষে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে এর প্রতিফলন ঘটাতে হবে। কেননা আমরা জানি, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত স্থিতিশীল পরিবেশ। উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে কঠোর পরিশ্রম ও সততার সঙ্গে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।দেশের চলমান উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে কাজকরা খুবই জরুরি। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য। ডেল্টা টাইমস/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |