শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৪ আশ্বিন ১৪৩১

অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদের রাজনীতি ও সাহিত্যের মূল দর্শন মানবমুক্তি ভাবনা
মোহাম্মদ এনামুল হক
প্রকাশ: রোববার, ২৮ মে, ২০২৩, ১:৩৯ পিএম | অনলাইন সংস্করণ

অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদের রাজনীতি ও সাহিত্যের মূল দর্শন মানবমুক্তি ভাবনা

অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদের রাজনীতি ও সাহিত্যের মূল দর্শন মানবমুক্তি ভাবনা

অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদ ছিলেন একাধারে শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, লেখক, শিক্ষানুরাগী, ভাষাসৈনিক,  সমাজসেবক, মানবিক ও অসম্প্রদায়ীক একজন মহান ব্যক্তিত্ব। নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদের অনেক কিছু অজনা। তাঁর লেখা বই গুলো পাওয়া অনেক দুষ্কর। একসাথে, জাতীয় কিংবা স্থানীয় পর্যায়ে তাঁকে নিয়ে ও তাঁর দর্শন নিয়ে যে আলোচনা হওয়া উচিত তা নিতান্ত অল্প৷ তবুও, মহান মানুষরা হারিয়ে যায় না, বেঁচে থাকে তাঁর কর্মে ও অবদানে।আসহাবউদ্দীন আহমদ ছিলে এমনই একজন বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময় প্রতিভা। যাকে অবহেলা করেও ভুলিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত মানবমুক্তির জন্য সংগ্রাম করে গেছেন।

আসহাব উদ্দীন আহমদ ১৯১৪ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার  সাধনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের মক্তবে পড়ালেখার হাতেখড়ি তাঁর। সাধনপুর বাণীগ্রাম হাইস্কুল থেকে ১৯৩২ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাশ করেন।  তারপর চট্টগ্রামে কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করে। ১৯৩৯ সালে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে এমএ পাস  করেন।

চট্টগ্রাম কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনার  মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৩৯ - ১৯৪১  সাল পর্যন্ত সেখানে ছিলেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজে( বর্তমান মহসীন কলেজ)   পশ্চিমগাঁও নওয়াব ফয়জুন্নেসা কলেজে, ফেনী কলেজে ও কুমিল্লা কলেজে অধ্যাপনা করেন। তিনি চৌদ্দ বছর এই পেশায় ছিলেন।

শিক্ষকতা ছিল তাঁর স্বপ্ন, ছোটবেলা থেকে  তিনি অন্য দশজনের মতো তথাকথিত ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারের হওয়ার ইচ্ছে পোষণ না করে শিক্ষক হতে চেয়েছেন। সে কথা তিনি স্কুলে পড়াকালীন স্কুল পরিদর্শকেও বলেছিলেন।

শুধু অধ্যাপনার মধ্যে তিনি সীমাবদ্ধ ছিলেন না, শিক্ষা প্রসারে ভূমিকা রেখেছেন অনন্য ।  তিনি চট্টগ্রাম সিটি কলেজ,বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ, সাতকানিয়া কলেজ, সাধনপুর পল্লী উন্নয়ন হাইস্কুল, পশ্চিম বাঁশখালী হাইস্কুল, বাহারছড়া রত্নপুর হাইস্কুলসহ  অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখেন।

১৯৫০ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ইংরেজি অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেছিল। সেখানে ইসলামের  ইতিহাসে বিভাগের অধ্যাপক আবুল খায়েরর সংস্পর্শে  সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় আকৃষ্ট হয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ও পরে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়।  ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। 'কুমিল্লায় ভাষা আন্দোলন ' সংগঠন পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন। পাকিস্তান শাসকের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রাসন প্রতিরোধে কুমিল্লায় 'প্রগতি মজলিশ' নামক সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

 পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্তে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করেন। তিনি চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের সহসভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিবার্চিত হয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পার্থী হয়ে  নিজ নির্বাচনী এলাকা থেকে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ( এম. এল. এ)  নির্বাচিত হন। বিপ্লবী রাজনীতির অনুসারী হওয়ার জন্য পাকিস্তান আমলে তিনি এক বছর জেল খাটেন এবং রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে তিনি ১৫ বছর আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলেন৷ তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ছিল মানব সমাজের মুক্তির দর্শন।

তিনি কোন দলদাস কিংবা স্বার্থপর  রাজনীতিক ছিলেন না। তাই সুবিধাবাদীদের ভিড়ে নিজেকে স্থির রাখতে পারেন নি। সেজন্য দীর্ঘ হতাশা নিয়ে তিনি রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর লেখা গ্রন্থ 'বোকামিয়ার ইতিকথা '( আত্মজীবনী) তে  বলেছেন ,'আমার মতো সরল মানুষের জন্য রাজনীতি নয়। আমি যেন পথ ভুলে রাজনীতিতে এসেছি। আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক জীবনকে একটা দুঃস্বপ্ন মনে হতে লাগল'

আসহাবউদ্দীন আহমদ অধ্যাপক, রাজনীতিক হিসেবে  সমাজ ও রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন। তিনি তাঁর এই অভিজ্ঞতা ও যাপিত জীবনের বাস্তবমুখী অভিজ্ঞতা ও ঘটনার ব্যাখ্যা - বিশ্লেষণ করে রচনা করেছেন অনেক গ্রন্থ। নতুন প্রজন্মের কাছে এইসব গ্রন্থ পুনর্মুদ্রণ না হওয়ায় পাওয়া দুর্লভ। জীবনমুখী ও বাস্তবমুখী রচনাসমূহ সমাজ বিশ্লেষণের দলিলে পরিণত হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের  অধ্যাপক মোহাম্মদ আলম চৌধুরীর লেখা 'আসহাবউদ্দীন আহমদ ও মানবসমাজের মুক্তি ভাবনা ' গ্রন্থে  বলেন, 'আসহাবউদ্দীন আহমদ এর ঘটনা - বর্ণনা একটু ব্যতিক্রমধর্মী।  প্রথাগত নায়ক - নায়িকার রসালাপ তথা প্রেমরসে তাঁর রচনা সিক্ত নয়। হাসি- ঠাট্টা - মশকরার ভেতর দিয়ে তিনি তাঁর দর্শন গেঁথে দিয়েছেন ভাবের বর্ণমালায়। সামাজিক অসংগতি, অবিচার, ঘুষ, যৌতুকপ্রথা, শাসক -শাসনের ছলে শোষণ প্রভৃতির প্রকৃত সুরত বিদ্রুপের ভেতর দিয়ে তুলে ধরেছেন'।

 অধ্যাপক মোহাম্মদ আলম চৌধুরীর লেখা প্রকাশিত গ্রন্থে তিনি আসহাবউদ্দীন আহমদের লেখা দুর্লভ সেসব গ্রন্থের নাম তুলে ধরেছেন
আসহাবউদ্দীন আহমদের প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ:

১. ধার, ২. বাদলের ধারা ঝরে ঝর ঝর৩. উদ্ধার, ৪. সের এক আনা মাত্র, ৫. জান ও মান, ৬. Bande votarm (ইংরেজি ভাষায়) ৭. মীর জাফরী ঐতিহ্য, ৮.পথ চলিতে,৯. হাতের পাঁচ আঙ্গুল, ১০. লেখক ও পাচক, ১১. দাড়ি সমাচার, ১২. বিপ্লব বনাম অতি বিপ্লব, ১৩. ভাতের বাংলা কাপড়ের বাংলা, ১৪. বাঁশ সমাচার, ১৫. দ্বিপদ বনাম চতুষ্পদ, ১৬. আমার সাহিত্য জীবন, ১৭. ইন্দিরা গান্ধীর বিচার চাই, ১৮. চিঠিপত্র, ১৯. ঘুষ, ২০. উজান স্রোতে জীবনের ভেলা, ২১. দাম শাসন দেশ শাসন, ২২. ভূমিহীন কৃষক, কড়িহীন লেখক, ২৩. সেরা রম্য রচনা, ২৪. সংবর্ধনার উত্তরে ভাষণ ‘উজান স্রোতের যাত্রী’, ২৫. বোকামিয়ার ইতিকথা ( আত্মজীবনী) ২৬. A Tale told by an Idiot.

এই মহান ব্যক্তি সাহিত্যে তাঁর গৌরবময় অবদান ও কীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৫ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন।
অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদ তাঁর জীবন দর্শনের মূল ব্রত ছিল মানুষের মুক্তি। তিনি ছিলেন মানব মুক্তির স্বাপ্নিক পুরুষ। সমাজ পরিবর্তনের জন্য তিনি শিক্ষতা ছেড়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন।ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থের উপরে তিনি দেশ ও দেশের জনগনের স্বার্থের জন্য রাজনীতি করতেন। কিন্তু তত্ত্বগত রাজনীতি থেকে বাস্তবের রাজনীতিতে নগ্নতা, সুবিধাবাদ, নেতৃত্বলোভী, ব্যক্তিস্বার্থকে জনগনের উর্ধ্বে স্থান, ক্ষমতাসীনদের লেজুড়বৃত্তি রাজনীতির জন্য তিনি ১৯৮১ সালে রাজনীতির মাঠ থেকে ইস্তফা দেন। কিন্তু সবসময় রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন।

তাঁর লেখার মাধ্যমে ছিল চিন্তা, রাজনীতি, সমাজচিন্তা ও মানবমুক্তির সুর। তিনি সবসময় স্বপ্ন দেখতেন বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র ও আদর্শচ্যুতির রাজনীতির অন্ধকার জগৎ থেকে সাধারণ মানুষের জীবন কে উন্নত করা যায়। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের প্রচেষ্টা ছিল তাঁর জীবন জুড়ে।

আসহাবউদ্দীন আহমদ দেশের সংকটে এগিয়ে এসেছিলেন নিবেদিত প্রাণ নিয়ে। তিনি ছিলেন আদর্শ ও নীতিবান রাজনীতিক,সফল শিক্ষক ও রম্য রচনার শৈলীতে অনবদ্য লেখক।তাঁর সম্পর্কে বাংলা একাডেমির মহাপরিচলক  মুহাম্মদ নরুল হুদা বলেন, ' দীর্ঘ আশি বছরের সচেতন জীবনে তিনি ছিলেন এক সদাচারী মানুষ। অর্থাৎ সাদা মনের মানুষ। উক্তি ও উপলব্ধিতে অভিন্ন এক মানুষ। সকল পরিস্থিতিতে এক কথা বলার মানুষ। জীবনের যেকোন সঙ্কটক্ষণে ইতিবাচক প্রতিবাদের মানুষ। নিজের বিষয়ে সব সময়ে নীরব থাকার মানুষ। এমন মানুষ জন্ম গ্রহণ করে বটে,তবে তার সংখ্যা শতাব্দীর শতজনে হয় কিনা সন্দেহ ' ( হুদা ২০১৪)
 
এই মহান মানুষ ২৮ মে, ১৯৯৪ সালে ঢাকায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ সংলগ্ন প্রিয় কৃষ্ণচূড়ার ছায়াসুশীতলে  চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
আজ এই  মহান মানুষ কে শ্রদ্ধাবরে স্মরণ করছি।


লেখক : শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


ডেল্টা টাইমস্/মোহাম্মদ এনামুল হক/সিআর/এমই

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬১, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬১, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com