স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু
রায়হান আহমেদ তপাদার
|
![]() . সেই বোধ থেকেই ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। বঙ্গবন্ধু প্রথমে দলের যুগ্ম সম্পাদক, পরে ১৯৫৩ সালে সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৬ সালে সভাপতি হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পরতে পরতে মিশে আছে জাতির পিতার অসামান্য অবদান। তাঁর অনুপমেয় বাগ্মীতা ও রাজনৈতিক সৃজনশীল প্রজ্ঞায় চীর ভাস্বর।ওই ভাষণে তিনি তৎকালীন পরিস্থিতি,বাঙালি জাতির আবেগ, স্বপ্ন ও অস্তিত্ব রক্ষা কে একসূত্রে গেঁথে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, যা ছিল মূলত পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ডাক। ৭ মার্চের ভাষণের রয়েছে দীর্ঘ আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বঞ্চনার ইতিহাস। ওই ভাষণ আমাদের প্ররণার চিরন্তন উৎস। বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার ওই ভাষণের দিক-নির্দেশনাই ছিল সে সময় বজ্রকঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমিত শক্তির উৎস ছিল এই ঐতিহাসিক ভাষণ। জাতির পিতার এ কালজয়ী ভাষণ ছিল মুক্তিকামী বাঙালির মোহিত মহাকাব্য। এ ভাষণে জাতির পিতার লড়াকু, সক্ষ্ণদর্শী ও স্বপ্নাদিষ্ট প্রতিভার স্ফূরণ প্রকাশ পেয়েছে। এ শোভিত ভাষণ পাল্টে দিয়েছে একটি দেশের মানচিত্র, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত। এ ভাষণে ছিল বহুমাত্রিকতায় বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। এ ভাষণ শুধু বাঙালি জাতির জন্যই নয়, এটি বিশ্বমানবতার ইতিহাসে শোষিত- বঞ্চিতদের অবিস্মরণীয়, অনুকরণীয় মহামূল্যবান দলিল। ইউনেস্কোর সিদ্ধান্তে এটিই স্বীকৃত হয়েছে। গণতন্ত্র, সুখৈশ্বর্য মানসিকতা, ত্যাগ দেশপ্রমের উজ্জ্বল আদর্শ,অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম, জাতিভেদ-বৈষম্য ও জাতি নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্ব মানবতার মুক্তির সংগ্রামে যুগে যুগে এ ভাষণ অনুপ্রেরণা জোগাবে। বাংলাদেশের স্বাধিকার তথা স্বাধীনতা সংগ্রামকে আমরা কয়েকটি ধাপে ভাগ করতে পারি। পঞ্চাশের দশকের রাষ্ট্রভাষা ও শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন, ষাটের দশকের শিক্ষা ও সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন,ছেষট্টিতে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা পেশ,আটষট্টিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, মার্চের অসহযোগ আন্দোলন এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে যেমন স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য কী করতে হবে, সে সম্পর্কে দেশবাসীকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন, তেমনি আলোচনার দরজাও খোলা রেখেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি ফয়সালা হয়ে যাক। বাঙালি স্বশাসন ফিরে পাক। কিন্তু বর্বর পাকিস্তানি শাসকেরা বাংলাদেশের মানুষের ওপর অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিলেন। অর্থাৎ স্বাধীনতার যুদ্ধের সশস্ত্র পর্ব শুরু হলো। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু যেমন অনন্যসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি এ কথাও সত্য যে সুহৃদ রাজনীতিক, সহযাত্রী আমলা-সামরিক কর্মকর্তা, সহযোগী নেতা-কর্মী, রাজপথে লড়াকু ছাত্র-তরুণদের সক্রিয় সহযোগিতায় তিনি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবর্ষ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও গর্বের। এই অনন্য দুই মহান উপলক্ষ আমাদের বাংলাদেশ সৃষ্টির মুহূর্ত এবং সেই সৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর অনন্য ভূমিকার কথা আরেকবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। উপনিবেশ-উত্তর আমলে বাংলাদেশই একমাত্র ভূখণ্ড, যেটি নৃতাত্ত্বিক-ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছিল। এর আগে এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার কোথাও এ ধরনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি। আমাদের আরেক স্মরণীয় সাফল্য হলো মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে আমরা পাকিস্তানের উপনিবেশ থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলাম। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার যাদুকরি মন্ত্রে উজ্জীবিত করে। কোনো ধরনের সমঝোতা বা আপেসের পথে না গিয়ে, সমস্ত রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর মনোমোহিনী আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ৩০ লাখ মানুষ জীবন উৎসর্গ করে। যা মানব ইতিহাসে কালজয়ী ও নজিরবিহীন।৭ মার্চের অন্যতম দীপাধার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নেতৃত্বের সর্বোচ্চ দেশপ্রেম, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির এবং লক্ষ্য অর্জনে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি। এ ভাষণের আরকটি দিক হলো, এটি সময়ের পরিক্রমায় আবদ্ধ না থেকে কালোত্তীর্ণ ও নবোদিত একটি মোহমুগ্ধ প্রেরণা। এ ভাষণের আরকটি ইতিবাচক দিক হলো এর কাব্যিক গুণ-শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাস। যা হয়ে ওঠে শ্রুতিমধুর, গীতিময়ী ও ঔজ্জ্বল্য অনুপ্রেরণা। যে কেনো শ্রেষ্ঠ ভাষণেই উত্থিত হয় সাম্প্রতিক বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে, ফলে তা তাৎক্ষণিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও হৃদয় থেকে নিঃসৃত বলা যায়। জাতির পিতার এ কালজয়ী ভাষণও ছিল তাই। যা কোনো পূর্ব পরিকল্পিত সাজানো-গোছানো গতানুগতিক বাকসর্বস্ব লিখিত বক্তব্য ছিলো না। এ ভাষণের অপর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি আকারে ছিল নাতিদীর্ঘ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উভয় স্তরে অসংখ্য ভাষণ ও বক্তব্য প্রদান করা হয়। তবে সকল ভাষণ বা বক্তব্য মানুষের হৃদয় নাড়া দিতে পারে না। এমনকি গুরুত্ব ও তাৎপর্যও এক রকম হয় না। যে ভাষণে অমানিশায় ডুবতে থাকা জাতি একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্দেশনা পায়। যাতে থাকবে দেশাত্মবোধ, আদর্শ ও স্বতন্ত্র জাতিস্বত্বা বিনির্মাণে উদ্বুদ্ধ হয়, এমনকি রক্তক্ষয়ী বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে বিজয়ের পতাকা নিয়ে বিশ্বের বুকে তুলে ধরতে পারে একটি মানচিত্র। এমন ধরণের ভাষণেই ব্যতিক্রম ভাষণ হিসেবে বিবেচিত। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে দেয়া ভাষণ অনন্য ও সম্মোহনী। বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ, ক্ষুরধার, তেজস্বিতা,বাগ্মীতা, দৃঢ়তা, দূরদর্শিতা, সুদুরপ্রসারি চিন্তা, দ্বিগ্বিজয়ী, প্রসন্ন, পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টিত সময়োপযোগী পরিশীলিত প্রয়োজনীয়- তার নিরিখে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার সক্ষমতায় এ ভাষণ ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী। এ ভাষণই ছিলে বাঙালি জাতির পরোক্ষভাবে মুক্তির সনদ। স্বাধীনতা ছিল বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। তবে এ স্বাধীনতা একদিনে অর্জিত হয়নি। সর্বশেষ বিষয়টি ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য। ১৯৫০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকেই বাঙালি অর্থনীতিবিদেরা গবেষণা করে দেখাতে থাকেন কীভাবে পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হচ্ছে এবং বাঙালির টাকায় কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি ফুলে–ফেঁপে উঠছে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টি ছয় দফার ভিত্তি রচনা করে। ১৯৪৮ সাল থেকেই জাতীয়তাবাদী সব আন্দোলনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু জড়িত ছিলেন। ১৯৫০-এর দশকে তিনি জনগণের সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগকে সুসংহত করেন এবং বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একজন অনমনীয় নেতা হিসেবে জনমনে স্থান করে নেন। ১৯৬০-এর দশকে যখন তিনি ছয় দফা আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, তখন থেকেই বাঙালি জাতি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। মহান ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জনের দীর্ঘ এ পথ পরিক্রমা ছিলো বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম সাহস, দেশপ্রেম, সীমাহীন ত্যাগ-তীতিক্ষা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, প্রতিস্বিক দিকনির্দেশনা জাতিকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সাথে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিকাল ৩টা ২০ মিনিটে লাখো জনতার বজ্রকণ্ঠে ১৮ মিনিটব্যাপী যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন তা আজও বিশ্বের ইতিহাসে শ্রুতিমধুর ও মর্মস্পর্শী হিসেবে সমাদৃত। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসজুড়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালিদের যে ঐক্য দেখা গিয়েছিল, তা নজিরবিহীন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন, তখন সারা দেশের মানুষ, এমনকি সরকারি কর্মচারীরাও সে ডাকে সাড়া দেন। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের কার্যত সরকারপ্রধান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। বাঙালিরা নিজেদের একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে অনুভব করতে শুরু করে। এই অনুভূতিই তাদের মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বঙ্গবন্ধু অভ্যুদয় ঘটিয়েছেন স্বাধীন-সার্বভৌম এক নতুন দেশের, যার নাম বাংলাদেশ। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এ দেশটির নাম উচ্চারণ করেছিলেন তার এক কালজয়ী গীতি কবিতায়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা উচ্চারণ করে বাস্তবে রূপায়িত করেছেন।এই বাংলাদেশ, এই বাঙালি সত্তাকে বঙ্গবন্ধু বিপুলভাবে ভালোবাসতেন। তিনি ছিলেন বাঙালি ঐতিহ্যের ও সংস্কৃতির ধারক। তার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে বাঙালি পরিচয়। তাই ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তিনি ঠিক করেছিলেন, ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ,বাংলা আমার ভাষা,জয় বাংলা।বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন চিরকাল বাঙালি জাতিকে অনুপ্রাণিত করবে, পথ দেখাবে। বাঙালি জাতি শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসায় বাংলাদেশের ইতিহাস বিনির্মাণের কালজয়ী এ মহাপুরুষকে চিরকাল স্মরণ করবে। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য। ডেল্টা টাইমস্/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |