শিশুদের পিঠে বইয়ের বোঝা কমানো দরকার
মো. জিল্লুর রহমান
|
নতুন বছরের শুরুতে নতুন শ্রেণিতে নতুন বই পেতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর চোখে মুখে থাকে আনন্দের ঝিলিক। নতুন বইয়ের পাতার গন্ধটা তার অনুপ্রেরণা ও আস্থার প্রতীক। এক্ষেত্রে ছোট বাচ্চা বা প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়ুয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আনন্দ, উৎসাহ- উদ্দীপনা থাকে চোখে পড়ার মতো। বছরের প্রথম দিন বেশ ঘটা করে বই উৎসব পালনের মাধ্যমে সরকার কর্তৃক বিনা মূল্যের পাঠ্যবই সারাদেশের শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
![]() . কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে শিশুর নিজের চেয়ে স্কুলের বইয়ের ব্যাগের ওজন বেশি। শিশুর কাঁধে বই খাতার বোঝা কমানো দরকার। আমাদের দেশে কেজি স্কুলে ক্লাস ওয়ানে উঠতে চার বছর সময় লাগে। পৃথিবীর আর কোথাও এ পদ্ধতি নেই। এ পদ্ধতির অবসান হওয়া প্রয়োজন। সরকার বিনা মূল্যে শিক্ষার্থীদের বই বিতরণ করলেও বেসরকারি নামি-দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অভিভাবকদের জোড় করে অতিরিক্ত বই কিনতে বাধ্য করছে। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকলেও তা অমান্য করে শিশুদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা। এক একটি বইয়ের বোঝা নয়, যেন এক একটি মানসিক চাপ। এতে করে মানসিকভাবে ব্যাপক চাপ এবং শারীরিকভাবেও ছোট ছোট বাচ্চারা বেশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। চিকিৎসকদের মতে, ১৮ বছর পর্যন্ত শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের উৎকৃষ্ট সময়। এ সময় শিশুর হাড় ও মাংসপেশি যথেষ্ট নরম থাকে। এ বয়সেই সামান্য আঘাতে অথবা চাপে মেরুদণ্ড বেঁকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অথচ এই বয়সেই প্রতি নিয়ত একটি শিশুকে ব্যাগের বোঝা বহন করতে হচ্ছে; যে বোঝাটি পিঠে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হচ্ছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের শিশু শিক্ষার্থীদের। এটা ওদের জন্য বিরাট পীড়াদায়ক ঘটনাও বটে। প্রতিনিয়ত ভারী বইয়ের বোঝা কাঁধে বহন করায় শিশুরা আর্থ্রাইটিস ও অস্টিওপোরোসিসের মতো দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কায় থাকে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। স্কুলগামী শিশুদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় কোমলমতি শিশুরা স্কুলের বই-খাতার বিশাল ব্যাগ বহন করছে। অনেক স্কুলে কেবল দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণিতেই ৮-১০টি করে বই দেখা যায়। যদিও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) অনুমোদিত ও বিনা মূল্যে বিতরণ হওয়া বই ছাড়া শিশুদের কাঁধে অন্য কোনো সহায়ক বইয়ের বোঝা না চাপাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে নির্দেশ রয়েছে। অথচ এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রাথমিক স্কুলের শিশুদের শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী স্কুলব্যাগ বহন নিষেধ করে সুনির্দিষ্ট একটি আইন প্রণয়ন করতে ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর একটি নির্দেশ দিয়েছিল উচ্চ আদালত। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, কিন্ডারগার্টেন ও অনেক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর শুধু বইয়ের চাপই দিচ্ছে না , করছে ব্যাপক অনিয়মও। তন্মধ্যে দৃষ্টিকটু অনিয়মটি হচ্ছে- কিন্ডারগার্টেনের প্রধানের পদ-পদবি; যে পদবিটি ব্যবহার করা হচ্ছে অধ্যক্ষ হিসেবে। হাস্যকর হলেও সত্যি, সেই অধ্যক্ষদের বেতনাদি দুই-আড়াই হাজারের মধ্যে এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা বড়জোর স্নাতক। আর অন্যান্য শিক্ষকদের বেতন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নামকাওয়াস্তে যৎসামান্য। শুধু কিন্ডারগার্টেন নয়, অনেক ব্যক্তি মালিকানাধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও একই অবস্থা বিদ্যমান। শিক্ষকরা অবশ্য এ বেতনাদি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন। এগুলো একটি শিক্ষকের পদ নয়, যেন এক একজন বিজ্ঞাপনদাতা। তার প্রধান কারণ তিনি শিক্ষক হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছেন এলাকায়; যাতে তার টিউশন করার সুযোগ বেড়ে যায় মুহূর্তেই। আর কিন্ডারগার্টেন কর্তৃপক্ষেরও পোয়াবারো; মালিকেরা এদের কম বেতনাদি দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন! এ হচ্ছে দেশের কিন্ডারাগার্টেনের হালহকিকতের যৎসামান্য চিত্র। এসব কিন্ডারগার্টেন ও এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত বই, খাতা, কলম, পোশাক, টিফিন বক্স ইত্যাদি কোমলমতি শিশুদের উপর চাপিয়ে দিয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের চেষ্টা করে যা একদিকে যেমন অনৈতিক, অন্যদিকে শিশুদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের পরিপন্থি। সরকারের বিভিন্ন মহলের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও কোনোভাবেই যেন অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এতে করে একদিকে যেমন শারীরিকভাবে সমস্যাগ্রস্থ হচ্ছে তেমনি মানসিকভাবেও চাপের মুখে পড়ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে সরকার বিনা মূল্যে নতুন বই তুলে দিলেও বাড়তি বই কিনতে বাধ্য হচ্ছে অভিভাবকরা। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নির্ধারিত বই ছাড়াও অভিভাবকদের হাতে বাড়তি বইয়ের তালিকা তুলে দিচ্ছে বেসরকারি স্কুলগুলো। যার কারণে এক প্রকার বাধ্য হয়েই বইয়ের দোকানগুলোতে ভিড় করছে অভিভাবকরা। এতে স্বল্প আয়ের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের অতিরিক্ত বই কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। বলা হয় আজকের শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার ও জাতি গঠনের কারিগর। অথচ এই শিশুদের পিঠে বইখাতার বিশাল বোঝার চাপ পড়ায় তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা শিশুদের ওপর থেকে বইয়ের বোঝা কমানোর তাগিদ দিয়ে বলছেন, ‘উন্নত দেশের মতো শ্রেণিকক্ষের শিক্ষা বইহীন করা না গেলেও যেকোনো উপায়ে বইয়ের সংখ্যা কমানো খুবই জরুরি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনহীন বই চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে নীতিমালা গ্রহণ করা অপরিহার্য। লক্ষ্য করলে দেখা যায় প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি পার হলেই শুরু হয় অসংখ্য অনুমোদনহীন বই পড়ানোর চাপ। ফলে প্রত্যেক শ্রেণিতে সরকার অনুমোদিত বইয়ের বাইরেও কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেওয়া অনেক বই পড়তে বাধ্য হয় শিশুরা। বেসরকারি স্কুল বিশেষত শহরাঞ্চলের কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের ১৩ থেকে ১৪টি বিষয়ও চাপিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো এসব বই প্রকাশনা সংস্থার কাছ থেকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে লাখ লাখ টাকা নিয়ে পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এনসিটিবি প্রতিবছর অনুমোদনহীন এসব বই পড়ানোর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিলেও ফলাফল শূন্য। কারণ এ অপরাধ দমনে নেই মন্ত্রণালয়সহ সরকারের অন্য কোনো নজরদারি। কীভাবে বইয়ের সংখ্যা কমানো যায় এমন প্রশ্নে অনেক শিক্ষক বলছেন, তাদের সময়েও ছিল একটি বইয়ের মধ্যে অনেক বিষয়। একটি রসায়ন, পদার্থ ও একটি প্রাণিবিদ্যা যুক্ত করে একটি বই। এভাবে করতে পারলেও বইয়ের সংখ্যাটা কমে। জানা গেছে, শিশু শিক্ষার্থীদের কাঁধে বইয়ের বোঝা কমাতে এরই মধ্যে উদ্যোগী হয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। শ্রেণি অনুসারে বইয়ের সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়ার পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা বইহীন করার বিষয় নিয়ে পরীক্ষামূলক প্রকল্প শুরু করেছে দেশটি। বইয়ের বদলে শিশুদের হাতে ‘ট্যাব’ তুলে দেওয়া যায় কি না, তা ভেবে দেখা দরকার। ওই ট্যাবগুলোর ওজন ২৫০ থেকে ৩৫০ গ্রাম। আর ট্যাবের মধ্যে পাঠ্যপুস্তকের সব ‘প্রিন্ট সংস্করণ’ যুক্ত করে দেওয়া যায় কি না, তা ভেবে দেখা যায়। এর ফলে শিশুদের আঙুলের ছোঁয়ায় ভেসে উঠবে বিভিন্ন ভাষার পাঠ্যপুস্তক। আমাদের দেশে প্রাথমিক স্তরের সরকারি প্রতিষ্ঠানের বাইরে আছে বহু প্রতিষ্ঠান, আছে হাজার হাজার কেজি স্কুল, যার দায়িত্বও মন্ত্রণালয়ের। প্রতিটি কিন্ডারগার্টেন অযাচিত বই পাঠ্যভুক্ত করে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ওইসব প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। স্কুল শুরু আর ছুটির সময় সারা দেশেই প্রতিদিন দেখা যায়, স্কুলের গেটে বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছেন। বইখাতা, পানির পট, টিফিন বক্স, রং-পেন্সিল বক্স এসব আনুষঙ্গিক জিনিস দিয়ে ব্যাগ ভরে তাদের শিশুসন্তান বিদ্যালয়ে ঢুকছে। শুধু কি তা-ই, বোর্ড নির্ধারিত বইয়ের পাশপাশি সহপাঠ নামে থাকে নানা কিসিমের নানা নামের বই। ব্যাগের ওজন সাত থেকে আট কেজিও হয়ে থাকে। শিশুদের শারিরিক ও মানসিক বিকাশে অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা না চাপিয়ে সরকারি নির্দিষ্ট নীতিমালা করে সময়োপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করলে যেমন শিশুরা উপকৃত হবে, তেমনি জাতিগঠনে তারা বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর হাইকোর্ট শিশুদের পিঠের বইয়ের অতিরিক্ত বোঝা কমাতে একটি নির্দেশনা দিয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল শিশুদের পিঠে শরীরের ওজনের ১০ শতাংশ ওজনের বেশি ব্যাগ বহন করা যাবে না। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত যেন না হয়, সেজন্য সরকারকে এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের নির্দেশনা দেয় হাইকোর্ট। নির্দেশনা দেয়া রায়ের কপি পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই এটি কার্যকর করতে, যা ছিল হাইকোর্টের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই রায় আজ অবধি বাস্তবায়ন হয়নি। আদৌ সেটি বাস্তবায়ন হবে কি না, তা নিয়েও সন্দিহান সংশ্লিষ্টরা। আদালতের নির্দেশ কিংবা সরকারের নির্দেশনার জন্য বসে না থেকে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে স্কুল কর্তৃপক্ষের উচিত শিক্ষার্থীদের বই-খাতার ভার লাঘবে উদ্যোগী হওয়া। বেসরকারি স্কুলের অ্যাসোসিয়েশনগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিতে পারে। অভিভাবকদেরও এ ব্যাপারে সচেতন ও সরব হওয়া দরকার। শিশুদের বাঁচাতে হলে পাশের হার নয়, শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে হবে, বইয়ের বোঝা কমাতে হবে। সেটা কীভাবে হবে তা খুঁজে বের করতে হবে সংশ্লিষ্টদেরই। স্কুল কর্তৃপক্ষকে তা বোঝাতে হবে। অভিভাবকদেরও সচেতন হওয়া দরকার। প্রত্যেকের যার যার অবস্থান থেকে অনুধাবন করা উচিত, শিশুর বইয়ের বোঝা আসলেই কমানো জরুরি। একগাদা বই, পানির বোতল, টিফিনবক্স ও ছাতা দিয়ে শিশুদের কাঁধে স্কুলব্যাগ তুলে দেওয়া হচ্ছে। এ বয়সে ব্যাগের বোঝা শিশুর শারীরিক বিকাশের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনই মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলছে। আনন্দদায়ক হয়ে উঠুক শিশুর শিক্ষাজীবন; শুধু বইয়ে মুখ গুঁজে নয়, হাসি-আনন্দ-খেলার ভেতর দিয়ে বিকশিত হোক শিশুরা এমনটাই বাস্তবায়ন করা দরকার। লেখক : ব্যাংকার ও কলাম লেখ ডেল্টা টাইমস/সিআর |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |