দেশপ্রেমের বারুদ উসখুস করে যার তিনি নৃপেন্দ্রনাথ মন্ডল
রাশেদুজ্জামান রাশেদ
|
![]() . অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষটির জীবন সংগ্রাম লিখতে গিয়ে স্মরণ হয় বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলামের কবিতার কয়েকটি চরণ “যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে, অস্তপাড়ের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে। বুঝবে সেদিন বুঝবে। ছবি আমার বুকে বেঁধে, পাগল হয়ে কেঁদে কেঁদে ফিরবে মরু কানন গিরি, সাগর আকাশ বাতাস চিরি, যেদিন আমায় খুঁজবে, বুঝবে সেদিন বুঝবে।” জয়পুরহাটবাসীর মাঝে নৃপেন্দ্রনাথ মন্ডল এখনও বেঁচে আছেন এবং সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন অবিরাম। হয়তো কোনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কিংবা তর্ক্কের আলোচনায় তাকে তেমন মূল্যায়ন করা হবে না। কিন্তু যেদিন তিনি আমাদের মাঝ থেকে চির বিদায় নিয়ে চলে যাবেন সেইদিন বুঝতে পারব যে একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক মানুষ চলে যাওয়াতে শূন্যতা কতটা প্রকট তৈরী হবে। একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে হত্যা করে যারা বাংলাদেশকে আরেকটি মিনি পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র কায়েম করতে চায় সেই গোষ্ঠির দ্বারায় তিনি বারবার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নৃপেন্দ্রনাথ মন্ডলের হাতে খড়ি শুরু হয় চক রঘুনাথ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তিনি আক্কেলপুর এফ ইউ পাইলট লাই স্কুল থেকে ১৯৭০ সালে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। পরে রংপুর কারমাইকেল কলেজ ভর্তি হন। কলেজে প্রথম বর্ষ শেষ করতে না করতে বাঙালি জাতির উপর নির্মম অত্যাচার নিপীড়ন বেড়ে যায় অর্থাৎ দেশে শুরু হয় যুদ্ধ। কলেজ ছেড়ে তিনি নিজ বাড়িতে চলে আসেন। এরপর সপরিবারে ভারতে চলে যান। তাই বাধ্য হয়ে তাকেও ভারতে যেতে হয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি বসে থাকে নি। কারণ ছোট থেকেই স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা বহমান। ফলে তিনি ভারতের প্রতিরাম ক্যাম্পে রেশাম ডেস্টিবিউশনে ক্যাম্পে ক্যাম্পে কাজ করেন। এর পর প্রতিরাম ইয়থ ক্যাম্পে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মুক্তিযুদ্ধের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। আলাউদ্দিন সরদার, ভবাণী প্রসাদ এবং আব্দুল জলিলের অনুপ্রেরণায় তিনি কাজ করেন। এর মধ্যে খবর আসতে শুরু করে পাকিস্তানের শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশ। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলার বীর সন্তানরা দীর্ঘ লড়াইয়ের শেষ মুহুর্তে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় পূর্ণ স্বাদ পাওয়ার পূর্বে ১৪ ডিসেম্বর দেশে নিজ ভিটেমাটিতে চলে আসেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে খাবারের জন্য হাহাকার সেখানে নতুন করে শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন। মনের মধ্যে সংকল্প নিয়েছেন। শিক্ষার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে হবে আর মানুষের সেবার জন্য বেড়িয়ে আসবে হবে। তাই নতুন করে জয়পুরহাট সরকারি কলেজে ইন্টারমেডিয়েডে লেখাপড়া শুরু করেন। সেখান থেকে ১৯৭৩ সালে এইচএসসি পাশ করেন। এর পর তিনি নওগাঁ কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হল শাখার সৎ একনিষ্ঠ ছাত্রনেতা ছিলেন। ছাত্র জীবনের ছা্ত্র রাজনীতি শিখেনছেন রাজনীতি মানে ভোগের নয় ত্যাগের। ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান উত্তরবঙ্গ সফর করার লক্ষে সান্তাহার থেকে আসার পথে আক্কেলপুর রেলওয়ে স্টেশনে সমাবেশ আয়োজন করেন বিএনপি। সেই দিন সকালের দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ বাজাতে শুরু করেন আক্কেলপুর রেলওয়ে স্টেশনরোডে আক্কেলপুর থানা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে নৃপেন্দ্রনাথ মন্ডলসহ আরও বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ,বীর মুক্তিযোদ্ধা ছাদেকুর রহমান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম। ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো শুরু করতেই আক্কেলপুর থানার এক দল পুলিশ এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর টেপ রেকর্ড পা দিয়ে লাথি মারে। তখন তাদের সাথে ঠেলাঠেলি বৎসা শুরু এবং তখন পুলিশ সব কিছু থানায় নিয়ে যায়। ![]() এ্যাড. নৃপেন্দ্রনাথ মন্ডল (পিপি) বাংলার অবিসংবাদিত নেতার ভাষণের টেপ রেকর্ড লাথি মেরে থানায় নিয়ে যাওয়া বড় অন্যায়। এ অন্যায় যেন মাথা নিচু করে সহ্য করার মত নয়। দ্রুত এ সংবাদ আক্কেলপুরে ছড়িয়ে পড়লে সেখানকার হাজার হাজার মানুষ আক্কেলপুর শহরে কালো পতাকা নিয়ে মিছিল শুরু করেন। আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ তৈরী হয় আক্কেলপুর শহরে। আর এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন নৃপেন্দ্রনাথ মন্ডল। শুরু হয় আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের উপর পুলিশী নির্যাতন। নৃপেন্দ্রনাথকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায় । পরের দিন বিকেলে ছাদেক ও জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রেপ্তার করে আনায় হয় থানায়। থানায় বেশি না রেখে বগুড়া জেলা কারাগারে নৃপেন্দ্রনাথসহ বাকী দুইজনকেও বন্দি করা রাখা হয় কয়েক মাসের জন্য। তাদের জেলা কারাগারে নির্মম নির্যাতন করে খেয়ে না খেয়ে রেখে দেয়। এমন ভাবে নির্যাতন করে মৃত্যুর স্বাদ যেন তিনি কাছের থেকে দেখেছেন। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে ৩রা মার্চ উপজেলা নির্বাচন বিরোধী আন্দোলনকে স্থগিত করার লক্ষ্যে স্বৈরাচার এরশাদ সামরিক শাসন জারি করলে ৯ মার্চ উপজেলা আদালত থেকে দারোগা কায়ুম মিয়া তাকে আক্কেলপুর থানায় নিয়ে আসেন। তারপর বগুড়া মার্শাল কোর্টে তাকে ও বামপন্থী নেতা আনোয়ার ইসলাম বাবুকে নিয়ে যান। এদিকে জেলে যাওয়ার আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু দাম্পত্ব জীবন বেশি দিনের সুখের হলো না। জেলখানায় কাটাতে হয় দিনের পর দিন,মাসের পর মাস। এর মধ্যে জেলখানায় খবর আসে তিনি সন্তানের বাবা হয়েছেন। কতটা কষ্টের জীবন জেলখানায় কাটাতে হয়েছে যে তাঁর আদরের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে নিতে পারছেন না। জেল খানায় তার সফর সঙ্গি আমিনুল বাবু তাঁর ছেলে নাম রাখেন বিপ্লব। বাবার সংগ্রামী জীবনের চিহ্ন রেখে দিলেন ছেলের মাঝে। এর পর তাদের মার্শাল কোর্টে বিচার করা হয় প্রায় সাত মাস পর কারাগার থেকে ছাড়া পান। জেল থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের অধিকারের কথা না বলা পর্যন্ত যার পেটের ভাত হজম হয় না। ১৯৮৯ সালে শিক্ষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে প্রায় ১ মাসের বেশি সময় ধরে আবারও সেই চিরচেনা বগুড়া জেলা কারাগারে থাকতে হয়। অপরদিকে Clean Heart Operation ও বিভিন্ন আন্দোলনে প্রায় ৮ বার হুলিয়া নিয়ে আত্মগোপন করে থাকতে হয়। এরপর তিনি জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলা আওয়ামিলীগের যোগদান করে ১৬ বছর দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক পদে ছিলেন। এরপর তিনি ১৯৯৭ সালে প্রথম দিকে জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মলেনে গোপন ব্যালট ভোটেরর মাধ্যমে বর্তান জয়পুরহাট- ১ সংসদ সদস্য সামছুল আলম দুদুকে পরাজিত করে সাধারণ সম্পাদক পদে জয়লাভ করেছিলেন। সততা দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি জেলার সিনিয়র সহসভাপতির হিসেবে সতাতর সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। একজন প্রকৃত কলম যোদ্ধা হিসেবে জয়পুরহাট জেলা প্রেসক্লাবের দীর্ঘ সময় ধরে নির্বাচিত সভাপতি এবং সেই সাথে জয়পুরহাট জেলা আদালতে সরকারি কৌঁশলী ও পাবলিক প্রসিকিউটর অর্থাৎ পিপির দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। যার কারণে জয়পুরহাট জেলার মানুষ তাঁকে পিপি নামে ডাকেন। এর পাশাপাশি জেলা আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ও বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খিষ্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জেলা সভাপতি এবং অন্যতম উপদেষ্টা দায়িত্ব পালন করছেন। এমনকি তিনি জয়পুরহাট জেলা আইনজীবী সমিতির বার বার নির্বাচিত সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি দৈনিক মায়ের আঁচল আঞ্চলিক পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে অসহায় মানুষের পরম বন্ধু হিসেবে কাজ করেন। বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার প্রাণ ও প্রকৃতিতে তাঁর সংগ্রামের কথা থাকবে যুগযুগ ধরে আরও নতুন করে ইতিহাস লেখা হবে বাংলার জনপদের অকৃত্বিম ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে। বাংলার নিখাদ মাটি থেকে উৎসারিত ‘মুজিব আদর্শ’ নিয়ে তিনি বহুদূর এগিয়ে যাবেন। এমন গরিবের বন্ধুকে জনপ্রতিনিধি করা হলে সাংগঠনিক কাঠামো ও যুগোপযোগী নেতৃত্বের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট । |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |