শিক্ষার মান উন্নয়ন ও গবেষণা বৃদ্ধির পথে অন্তরায় শিক্ষক রাজনীতি
ফজলে এলাহী ফুয়াদ
|
![]() . যেখানে বাংলাদেশর সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয় সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে, আর তাই রাজনীতি সকলের একটি অধিকারের অন্তভূক্ত। অ্যারিস্টটল মানুষকে সেরা ‘রাজনৈতিক প্রাণীথ হিসেবে বিবেচনা করেছেন, কারণ মানুষ মতপ্রকাশ করতে সক্ষম এবং কোনটি ন্যায় ও অন্যায়, সে সম্পর্কে তার ধারণা আছে। আজকের বাংলাদেশে অ্যারিস্টটলের সেই সেরা ‘রাজনৈতিক প্রাণীথর রাজনৈতিক বিবর্তন ঘটেছে। তবে সেটি প্রকৃতির অবদানে নয়, বরং জাগতিক বস্তুর প্রতি মানুষের লোভ, লালসা ও স্বার্থপরতা থেকে। এই রাজনৈতিক বিবর্তনে দেশের শিক্ষকসমাজ সবচেয়ে এগিয়ে। একজন শিক্ষক যখন রাজনীতির কাছে আদর্শ বিকিয়ে দেন, রাজনীতিকে ব্যক্তিস্বার্থ অর্জনের হাতিয়ার কিংবা ওপরে ওঠার সিঁড়ি বানান এবং কাউকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন, তখন তিনি আর শিক্ষক থাকেন না, হয়ে যান একজন ‘বিবর্তিত রাজনৈতিক প্রাণীথ। দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন এসব নব্য বিবর্তিত রাজনৈতিক প্রাণীর সবচেয়ে বড় চিড়িয়াখানা। এখানে অধিকাংশ শিক্ষক এখন কোনো না কোনো লেজুড়বৃত্তিক রাজনৈতিক সংগঠনের রেজিস্ট্রিকৃত সদস্য। আমার জানামতে, পৃথিবীর আর কোনো দেশে দলীয় শিক্ষকরাজনীতির এই ব্যাপকতা ও বাহুল্য নেই। শিক্ষকরাজনীতির কোনো র্যাঙ্কিং থাকলে নিঃসন্দেহে এ মুহূর্তে বাংলাদেশ শিক্ষক রাজনীতিতে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হতো। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অধিকারের সঠিক বাস্তবায়নের চেয়েও অপব্যাবহারই বেশি হচ্ছে বলে আমার মনেহয়।কেননা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক রাজনীতির নানাবিধ প্রভাব লক্ষ করেছি আমি আমার শিক্ষা জীবনে। আর তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ‘স্কুল অব থটথ নিয়ে। কোনো রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় নেওয়া অথবা ক্ষমতা থেকে নামিয়ে আনা শিক্ষকদের কাজ নয়। বিভিন্ন ‘স্কুল অব থটেরথ মধ্যে প্রতিযোগিতা চিন্তার ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান উৎপাদনের কাজটি সহজ হয়ে যায়। উন্নত দেশগুলোতে এমন ধরনের চর্চা অন্তত পাঁচশ বছর ধরে চলে আসছে। দলীয় কার্যক্রম প্রদর্শনের চেয়ে দেশের শিক্ষার মানোন্নয়নে নজর দিতে হবে।শিক্ষকরা দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে রাজনৈতিক ভূমিকাও পালন করবেন,দেশের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলে তাতেও তেমন দোষের কিছু দেখি না। ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী শিক্ষকরা রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারেন। তবে সরাসরি রাজনৈতিক দলে যুক্ত হয়েছেন খুব বেশি নয়। কিন্তু সমস্যাটা তখনই সৃষ্টি হয়, যখন দেখা যায় নতুন শিক্ষক নিয়োগের সময় তার দলের সমর্থনপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে তিনি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। শিক্ষকতা পেশা নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। উক্তিটি হলো, ‘ধন চাহত তাহা হইলে এই পথে আসিও না। মান চাহত তাহা হইলে এই পথে আসিও। তিন্তিড়ি বৃক্ষের পত্র ভক্ষণ করত জীবন ধারণ করিতে চাহো তাহা হইলে এই পথে আসিও। বিদ্যাসাগর মহাশয় শিক্ষকতা ব্রতের জন্য যেভাবে ত্যাগ স্বীকার করতে আহ্বান জানিয়েছেন সেটা হয়তো আজকের বাস্তবতায় মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তবে শিক্ষকদের মধ্যে যদি কিছুটা হলেও ত্যাগের মনোভাব বজায় থাকে তাহলে একজন শিক্ষক নিছক শিক্ষকই থাকবেন না, তিনি হবেন একজন সাধক। আজকের ভোগবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে কোনো পেশার মানুষের এ রকম ত্যাগ স্বীকার করতে সম্মত হওয়া বাস্তবধর্মী নয়। শিক্ষকরা যদি সাদামাটা জীবনযাপন করে, তাহলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়তে পারে। শিক্ষকরা নীল, গোলাপি ও সাদা রঙে নিজেদের রাঙিয়ে রেখেছেন। তাদের মনোজগতে শুধু একটি রাজনৈতিক দলের পতাকা উড়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি দেখতে পাচ্ছে না। শিক্ষকের চোখে পুরু চশমা থাকুক বা না থাকুক তিনি ঐ রাজনৈতিক দলটির ‘আয়নাথ দিয়েই দেখছেন চারপাশ। তিনি যে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, যেখানে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নিজেরাও ডুবে থাকার কথা গবেষণার কাজে, তেমন আচরণ নেই তার মধ্যে। তার কর্মকাণ্ড স্পষ্ট একজন রাজনৈতিক কর্মীর পরিচয় ফুটে উঠছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের যেকোনো দুর্বিপাকে শিক্ষক বা চিন্তক শ্রেণি কথা বলবেন, তাদের পর্যেবক্ষণ জানাবেন, এটাই স্বাভাবিক। পাকিস্তান আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের জন্য অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের বৈশিষ্ট্য কেমন হবে তা জানানোর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়োজ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের মতামত জ্ঞাপনের জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান একটি খসড়া তৈরি করে দেওয়ার আহ্বান জানান। আমি এদেরই একজনের কাছ থেকে জনতে পেরেছি ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় আইনের খসড়াটি তারা যেভাবে লিখে দিয়েছেন জাতীয় সংসদে সেটাই পাস হয়ে যায়। তবে এ আইনের খসড়া দেখে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব মন্তব্য করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যদি এতগুলো নির্বাচন হয়, তাহলে শিক্ষকরা পড়াবার সময় পাবেন কখন? বলা বাহুল্য, এ মানুষটি বুঝতে পেরেছিলেন অতি গণতন্ত্র অনেক সময় অতি ক্ষতিকর হয়। মানুষ রাজনৈতিক জীব। রাজনৈতিক বিশ্বাসকে পুঁজি করে অনেক ফায়দা লাভ করা যায়। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্বাসকে বিশ্বাসের জায়গায় রেখে শ্রেয় বোধের চর্চা করতে পারলে এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা অনেকেই নীতি-নৈতিকতা ও শ্রেয়বোধ হারিয়ে ফেলছি। ১৯৭৩ সালের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ শিক্ষকদের স্বাধীন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে, বিবেক দ্বারা পরিচালিত হওয়ার অবাধ সুযোগ দিয়েছে। এ স্বাধীনতা মানে এই নয় যে শিক্ষক রাজনৈতিক কোনো দল বা বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে মাথা নত করবেন, তাদের তুষ্ট করার জন্য আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবেন। কিন্তু রাজনীতির রং গায়ে মেখে আলোকিত ও বিবেকবান মানুষগুলো দুঃখজনকভাবে আজ ‘একচোখা বুদ্ধিজীবীথ কিংবা ‘সুবিধাবাদী প্রাণীথ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন, সামান্য ব্যক্তিস্বার্থের কাছে মাথানত করে দলীয় আদর্শের তোষামোদি করছেন। তাই এসব সব কিছুর উর্ধ্বে গিয়ে শুধু রাজনীতি নয় পাঠদানের পাশাপাশি গবেষণা কাজে মনোনিবেশ করে দেশ ও জাতির কল্যানে বিশেষ ভূমিকা রাখবেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, আমাদের সকল শিক্ষক এটিই আজকের প্রত্যাশা। লেখক: শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, ডেল্টা টাইমস্ কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার ডেল্টা টাইমস্ কর্তৃপক্ষ নেবে না। ডেল্টা টাইমস্/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |