রোহিঙ্গাদের ফেরার অনিশ্চয়তা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে
রায়হান আহমেদ তপাদার
|
![]() . ১৯৭৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো সরকারই বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন ও সহিংসতার মূল কারণ ও সমস্যাগুলো নিয়ে এখনো কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে। অন্য অনেক সংকটের মতোই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিদ্যমান সংকট নিরসনের জন্য দ্বিগুণভাবে কাজ করতে হবে এবং কার্যকর রাজনৈতিক সংলাপের জন্য সম্মিলিত ভাবে জোর দিতে হবে। কূটনৈতিক যোগাযোগ ও সমর্থন বাড়াতে হবে এবং নিরাপদ প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে মানবিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জোরদার করতে হবে। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের বাস্তুচ্যুতিও রোধ করা সম্ভব হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য ক্রমেই এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। দেশের নিরাপত্তা, পর্যটনশিল্প, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ অনেক বিষয়েই হুমকির সৃষ্টি হয়েছে। আবার কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণের ওপর এত বেশি চাপ সৃষ্টি হয়েছে যে তারাও রীতিমতো দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদসহ বিভিন্ন অপরাধীচক্র রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে নানা ধরনের অপরাধ নেটওয়ার্ক তৈরিতে তৎপর রয়েছে। স্থানীয় সন্ত্রাসীরাও তাদের দলে টানার চেষ্টা করছে। আবার বেসরকারি সংস্থার ছদ্মবেশেও অনেকে অনেক রকম উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্য মতে, চলতি মাসেই কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে দুষ্কৃতকারীদের গুলিতে এক রোহিঙ্গা নেতা নিহত হয়েছেন। একই দিন টেকনাফের পাহাড়ে চার কৃষককে অপহরণ করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। থানা সূত্রে ওই খবরে আরো উল্লেখ করা হয়, উখিয়া থানায় গত বছরের জুন থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৭টি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। অন্যদিকে ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রের খবরে বলা হয়েছে, টেকনাফের নাফ নদ তীরবর্তী হ্নীলা ও মেরিন ড্রাইভ-সংলগ্ন বাহারছড়া ইউনিয়ন দুটিতে গত দুই মাসে কমপক্ষে ২৫ জন স্থানীয় অপহরণের শিকার হয়েছে। সূত্র আরো জানিয়েছে, অপহরণের বিষয়গুলো নিয়ে স্থানীয় লোকজন সাধারণত থানায় যেতে চায় না। কারণ এসব ঘটনা মুক্তিপণ দিয়েই সমাধা করা হয়। ঠিক তেমনটিই ঘটেছে। কক্সবাজারের টেকনাফে অপহৃত তিন কৃষক ছয় লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য ক্রমেই ভয়ংকর বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। এটা এখন স্পষ্ট যে রোহিঙ্গা অস্ত্রধারীরা যেকোনো সময় আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বিপদ সৃষ্টি করতে পারে। দেশি-বিদেশি যেকোনো পক্ষ বা শক্তি, যারা বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক বা ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার করতেও সচেষ্ট হতে পারে। তারাও ওই অস্ত্রধারীদের ব্যবহার করতে পারে। এমনিতেই ১৯৭৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা ইস্যুটি হ্যান্ডল করার ব্যাপারে বাংলাদেশের কোনো সরকারই দূরদৃষ্টির পরিচয় দিতে পারেনি। ১৯৭৮ সাল থেকে এই ইস্যুতে কী ঘটেছে, এর সামনে-পেছনে কারা ছিল, তাতে বাংলাদেশের কী লাভ-ক্ষতি হয়েছে, তার সব কিছুই বিবেচনায় আনতে হবে। ভাবতে হবে, এই রোহিঙ্গারা অনির্দিষ্টকালের জন্য এভাবে যদি কক্সবাজারে অবস্থান করে, তাহলে বাংলাদেশের জন্য কী কী নিরাপত্তার সংকট সৃষ্টি হতে পারে, তার স্বরূপ ও বিস্তৃতি কেমন হবে এবং তার পেছনে দেশি-বিদেশি কোনো পক্ষ ও শক্তির কোনো হাত থাকতে পারে কি না ইত্যাদি বিবেচনা করে এখনই তা প্রতিরোধ করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়মিত গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রের ব্যবহার হয়। রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় সংকট সৃষ্টি করেছে। তাদের সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। কারণ রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য ক্রমেই এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গারা চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আরো কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত কাজে তারা জড়াচ্ছে। ফলে ওই সব এলাকার সামাজিক স্থিতি নষ্ট হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প যদি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে, তাহলে সেটি বাংলাদেশের জন্য মহাবিপদ হবে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। গত বছরের শেষ খবর ছিল,১৮০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে গত ২৫ নভেম্বর বাংলাদেশ থেকে ছেড়ে যায় নৌকাটি। ছয় দিন পরই ইঞ্জিন বিকল হয়ে সাগরে ভাসতে থাকে এটি। এক মাস সাগরে ভাসার পর অবশেষে কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গাকে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের তীরে নামতে দেওয়া হয়েছে। ইঞ্জিন বিকল হওয়ার পর নৌকাটি ভাসতে ভাসতে মালয়েশিয়ার জলসীমা থেকে ইন্দোনে- শিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় উপকূলে পৌঁছায়। এরপর এটি নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণে ভারতীয় জলসীমায় ঢুকে পড়ে। রোহিঙ্গাদের পরিবারের সদস্য ও মানবাধিকার কর্মীরা তাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে যোগাযোগ করতে পারছিলেন। তাঁরা জাতিসংঘের মাধ্যমে ভারত ও ইন্দোনেশিয়া কর্তৃপক্ষের কাছে সাহায্যের আবেদন করেন। যাত্রীরা জানান, তাঁরা অনেক দিন অভুক্ত এবং অনেকে মারা গেছেন। গত বছর ২৫ মে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রত্যাবাসনের দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তায় রোহিঙ্গারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হচ্ছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা তাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে দীর্ঘ অনিশ্চয়তার কারণে হতাশ হয়ে পড়ছে, যার একটি সম্ভাব্য ঝুঁকি রয়েছে। কারণ এটি তাদের অনেককে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে প্ররোচিত করছে। ১১ লাখের বেশি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার কারণে গভীর বনভূমি কক্সবাজারের উখিয়ার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। তারা গাছ কাটার মাধ্যমে বনভূমি হ্রাস এবং এলাকার পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। এছাড়াও প্রতিবছর ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসহ ভাসানচর দ্বীপে রোহিঙ্গাদের জন্য অস্থায়ী আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে। এ পর্যন্ত ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে অস্থায়ী আশ্রয়ে স্থানান্তর করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক বিবেচনায় প্রশংসিত হলেও দেশের ভবিষ্যত নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেই সম্মুখ যাত্রা অব্যাহত রাখতেই হবে। বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি আন্তর্জাতিক সংহতি এখন আগের চেয়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে বাংলাদেশের ওপর অভিঘাতের স্বরূপ বহুমুখী। ক্যাম্পগুলো ঘিরে মানবপাচারসহ মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের বিস্তার ঘটছে ভয়াবহভাবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গি সংগঠনগুলোর ধর্মীয় উন্মাদনায় উদ্বুদ্ধ করে রোহিঙ্গা যুবকদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা সম্পর্কে সবাই জানে। পরিশেষে বলব, যেকোনো বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বাংলাদেশের জন্য জরুরি, সময়ক্ষেপণ ঠিক হবে না। মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সরকার এবং তার সঙ্গে জোরালোভাবে ট্র্যাক টু ও ট্র্যাক থ্রি-কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে এবং আমাদের অবস্থান সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সমস্যাটি আন্তর্জাতিক, কিন্তু ভিকটিম বাংলাদেশ। সমস্যা সমাধানে সফল হতে হলে আত্মপর্যালোচনা ও আত্মসমালোচনা দরকার। আমাদের বোঝা উচিত ছিল এবং এখনো বুঝতে হবে মিয়ানমার রাষ্ট্র চালায় সে দেশের সেনাবাহিনী। তাদের কাছে রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা ও উন্নতির চেয়ে ক্ষমতায় থাকা জরুরি। ১২ লাখ নিপীড়িত-নির্যাতিত এবং চৌদ্দপুরুষের ভিটামাটি থেকে উৎখাত হওয়া ক্ষুব্ধ মানুষ, যার মধ্যে উঠতি বয়সি ও যুবক শ্রেণি হবে এক-চতুর্থাংশ, অর্থাৎ প্রায় আড়াই-তিন লাখ, বিপর্যয়ের ক্ষুব্ধতায় তারা প্রত্যেকেই হয়ে উঠতে পারে একেকটি স্বতন্ত্র বোমা। হতাশ ও সর্বহারা মানুষের পক্ষে অনেক কিছু করে ফেলা সম্ভব। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যত যা-ই হোক, বাংলাদেশ তার নিজের স্বার্থেই কখনো জঙ্গি, সন্ত্রাসী বা অন্য দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে না। এ ব্যাপারে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে। কিন্তু এত বিশালসংখ্যক উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী, যেখানে দেশ-বিদেশের অসংখ্য এনজিও এবং বহু পক্ষ সংগত কারণেই জড়িত, সেখানে বাংলাদেশ সরকারের শতভাগ সদিচ্ছা থাকলেও সব অপতৎপরতা ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। সম্ভব নয়। সুতরাং মিয়ানমার সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় না হলে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন। দিন যত যাবে, বাংলাদেশের নিরাপত্তার ঝুঁকি ততই বাড়বে। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য। ডেল্টা টাইমস্/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |