নিয়োগ জটিলতার ৪ বছর: মানসম্মত শিক্ষা কোথায়?
শাহাদাত আনসারী
|
সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। শিক্ষাক্ষেত্রেও উন্নয়ন ঘটেছে চোখে পড়ার মতো। তবে ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও শিক্ষার মানের তেমন উন্নয়ন হয়নি বলে শিক্ষাবিদরা মনে করেন। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সময়ের সাথে সাথে ঘনঘন নিয়মনীতি পরিবর্তন করা হচ্ছে। ফলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জটিলতায় পড়ছেন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (Sustainable Development Goal) এর ১৭টি লক্ষ্যের অন্যতম লক্ষ্য- ‘সকলের জন্য নায্যতাভিত্তিক ও মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতকরণ’। বাংলাদেশ এ লক্ষ্যের সাথে একমত পোষণ করে মানসম্মত শিক্ষা (Quality Education) নিশ্চিতকরণের জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসিত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বর্তমানে শিক্ষাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাঠদান করা হয়। শিক্ষক ঘাটতি পূরণের জন্য প্রায় প্রতি বছর বিজ্ঞপ্তির মাধমে মেধাবীদের প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু পিটিআইগুলোতে এখনও উল্লেখযোগ্য নিয়োগ সম্পূর্ণ করা হচ্ছে না। সম্প্রতি প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এর ইন্সট্রাক্টর ও পিটিআই অভ্যন্তরীণ পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে ঘাটতি কাটানোর চেষ্টা করা হলেও বিভিন্ন কারণে তা আটকে আছে। শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠান পিটিআই এবং পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয় এখনও জনবল ঘাটতিতে। শিক্ষার মান উন্নয়নে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (বিপিএসসি) এর মাধ্যমে দ্রুত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে পিটিআই ও পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের জনবল ঘাটতি কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। ২০১৮ সালে ইন্সট্রাক্টর (সাধারণ) রাজস্ব খাতে ৭৭টি সৃজিত পদে এবং ২০১৯ সালে পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের ৩২৯টি শিক্ষক পদে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন কর্তৃক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ৩-৪ বছর পার হলেও অজানা কারণে নিয়োগ পরীক্ষা আটকে আছে। দীর্ঘদিন পর কখনও যদি কোন ইন্সট্রাক্টর বা পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয় তাও আবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়ের করা রিট মামলায় স্থগিত হয়। এভাবে চলতে থাকলে প্রাথমিক শিক্ষা ধ্বংস হবে। তাই অতিদ্রæত বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (বিপিএসসি) কর্তৃক ইন্সট্রাক্টর (সাধারণ) এবং পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার পরবর্তী ধাপগুলো সম্পূর্ণ করতে হবে। আর এ উদ্যোগে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। দেশে বর্তমানে ৬৭টি পিটিআই আছে। প্রত্যেক পিটিআইতে পরীক্ষণ বিদ্যালয় আছে। এ বিদ্যালয়টির নাম পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়। এখানে ইনস্ট্রাক্টর ও শিক্ষকদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে হাতে কলমে শিক্ষা দেয়া হয়। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রয়োজন উন্নত শিক্ষাক্রম, পাঠ্যক্রম, অভিজ্ঞ শিক্ষক এবং প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ। প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয় প্রশিক্ষণ উপযোগী পরিবেশ দিয়ে থাকে। বিভিন্ন সময়ে শিখন ও শিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ঘাটতির কারণে তা ফলপ্রসু হচ্ছে না। পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয় জনবল তথা শিক্ষক সঙ্কটে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এখনে বর্তমানে কোন স্থায়ী শিক্ষক নাই। অস্থায়ীভাবে যারা আছেন তাঁরা পিটিআই সুপার বা প্রভাবশালী কোন ইন্সট্রাক্টরের আত্মীয়। জেলার সবচেয়ে ভালো শিক্ষককে বাদ দিয়ে এখানে আত্মীয় পরিচয় ও প্রভাব দিয়েই ডেপুটেশনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পাঠদান করছেন। অথচ পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের জন্য ২০১৯ সালে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু তাও নিয়োগ জটিলতায় আটকে আছে। তাই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এখনই পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের নিয়োগ সম্পন্ন করে মানসম্মত শিক্ষা অর্জনে সহযোগিতা করতে হবে। বর্তমানে কোন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ে স্থায়ী শিক্ষক নাই। চাকুরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত লিখিত পরীক্ষার ফল আলোর মুখ দেখেনি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের নিয়োগে কোন গতি দেখা যাচ্ছে না। এখনও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দ্বারা পরীক্ষণ বিদালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ফলে শিক্ষকের অভাবে মাঠ পর্যায়ে পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয় মূলত প্রাথমিক শিক্ষার এক আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এ বিদ্যালয়ে যদি নিজস্ব শিক্ষক না থাকে তাহলে দেশব্যাপি প্রাথমিক শিক্ষার মান এমনিতেই কমতে থাকবে। ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (বিপিএসসি) এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সারা দেশের পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের জন্য ৩২৯টি পদে ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড) ডিগ্রীধারীদের কাছ থেকে দরখাস্থ আহবান করে। তারই ধারাবাহিকতায় প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা হয়। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ২ বছর পর লিখিত পরীক্ষা হলেও এখন পর্যন্ত ফলাফল প্রকাশ করা হচ্ছে না। লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে পিএসসি চাকুরির জন্য সুপারিশ করবে যা সময় সাপেক্ষ। আবার ২০১৮ সালে ইন্সট্রাক্টর (সাধারণ) পদে বিজ্ঞপ্তি হয়ে থাকলেও ভাইভা পরীক্ষা আটকে আছে ২ বছর ধরে। ফলে যারা এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ফলাফলের প্রত্যাশা করছে তারা ধৈর্য হারা হয়ে পড়েছে। তাদের একটাই দাবি দ্রæত নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হোক। জেলা শহরে পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ে ১০ম গ্রেডে যারা শিক্ষক ছিলেন তাঁরা সবাই পদোন্নতি পেয়ে ৯ম গ্রেডে ইন্সট্রাক্টর পদে যোগদান করেন। ফলে পরীক্ষণ বিদ্যালয় এখন শিক্ষক শূণ্য। নিয়োগ না হওয়ায় আপতত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষকদের (১৩তম গ্রেড) ডেপুটেশনে চাকুরি করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ডেপুটেশনে এসে তাঁরা আবার স্থায়ী নিয়োগ চাচ্ছেন। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং নিয়োগবিধি বহির্ভূত। আবার যারা অন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ডেপুটেশনে এসেছেন সেখানেও শিক্ষক ঘাটতি। সরকারি কর্ম কমিশন এ সমস্যা দূর করে ফলাফল দিতে চাইলেও মামলা জটিলতায় নিয়োগ পরীক্ষা আটকে গেছে। তাই পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের পাঠদান মানসম্মত হচ্ছে না। মানসম্মত শিক্ষার জন্য এখন প্রয়োজন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ে স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ। লেখক: শিক্ষা গবেষক ও কলাম লেখক। ডেল্টা টাইমস্/সিআর/এমই
|
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |