প্রকৃত বন্ধুত্ব দিগন্ত বিস্তৃত হীরের টুকরোর মতো
মো. জিল্লুর রহমান:
|
বন্ধু দিবস বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন তারিখে পালন করা হয়। তবে এখনও বাংলাদেশ-ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আগস্টের প্রথম রোববারই বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তবে ২০১১ সালের ২৭ জুলাই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৩০ জুলাইকে "বিশ্ব বন্ধু দিবস" হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, ধর্ম ইত্যাদি নির্বিশেষে বিভিন্ন দেশের মানুষের বন্ধুত্বের একটি শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস ঘোষণা করে। জানা যায়, বন্ধুত্ব দিবসটির সূচনা হয়েছিল ১৯৩০ সালের ২ আগস্ট হলমার্ক কার্ডের প্রতিষ্ঠাতা জয়েস হলের মাধ্যমে। যখন লোকেরা তাদের বন্ধুত্ব দিবসটি ছুটির মধ্য দিয়ে উদযাপন করত। ১৯২০ সালে দিনটি গ্রিটিং কার্ড ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন দ্বারা প্রচারিত হয়েছিল। যেখানে অনেক গ্রাহকেরাই মনে করেছিল যে, গ্রিটিংস কার্ডের প্রচার করার জন্যই এই দিবসটি আনা হয়েছে। এটিকে সেই সময় বাণিজ্যিক কৌশল বলেই মনে করেছিল অনেকে। ১৯৪০ এর দশকে মার্কিন মুলুকে প্রচুর ফ্রেন্ডশিপ ডে কার্ড পাওয়া গিয়েছিল। যদিও ইউরোপে এরকম কিছুই পাওয়া যায়নি। তবে এশিয়ান দেশগুলো এই দিনটি পালন করা শুরু করে। ১৯৫৮ সালে প্যারাগুয়েতে প্রথম এই দিনটি সেলিব্রেট করা হয়। ডাক্তার রামন আর্টেমিও ব্রাকো ২০ জুলাই তার বন্ধু পুয়ার্ত পিনাস্কের সঙ্গে প্রথম ডিনার করে এই দিনটি পালন করেন। যদিও অনেক দেশে এই দিনটি ভিন্ন ভিন্ন তারিখে পালন করা হয়। যেমন- বাংলাদেশ, ভারতে এই দিনটি পালন করা হয় আগস্ট মাসের প্রথম রোববার। ব্রাজিল, উরুগুয়েতে ২০ জুলাই। বন্ধুত্ব এমন একটি সম্পর্ক, যাকে নিক্তি দিয়ে মাপা যায় না। সংজ্ঞা দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। ‘বন্ধু’- শব্দটি যতই ছোট হোক, কিন্তু এর গভীরতা আর ব্যাপ্তি অনেক বেশি। সব সম্পর্কের সেরা সম্পর্ক হলো বন্ধুত্ব। বন্ধু মানে এমন একজন, যাকে নির্দ্বিধায় মনের সব কথা বলা যায়, যার সঙ্গে নিজের কষ্ট ভাগ করা যায়, যে পাশে থাকলে পৃথিবী জয়ের সাহস পাওয়া যায়। মা-বাবার সঙ্গে যে কথাগুলো শেয়ার করা যায় না, তা নির্দ্বিধায় প্রিয় বন্ধুটিকে শেয়ার করে হালকা হওয়া যায়। প্রেম একসময় হারিয়ে যায়, কিন্তু বন্ধু কখনোই হারায় না। জীবনের কিছু ক্ষেত্রে আর কাউকে না পেলেও বন্ধুদের ঠিকই পাওয়া যায়। নতুন কিছুর শুরুতে স্বাভাবিকতই বাধার সম্মুখীন হলেও বন্ধুরা আপনাকে হতাশ করবে না। বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় বন্ধুরাই। আর এই বন্ধুত্ব যখন অটুট থাকে তখন দুরত্ব কিংবা সময় কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কিছুদিন আগে পতুল নামের এই মধ্যবয়স্কা নারীর কথাই ধরুন না। তিনি দীর্ঘ ৪৭ বছর পর কলেজ জীবনের বন্ধুদের খুঁজে পেয়েছে। তাও এক ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে। পাঁচ বান্ধবীর একজন পুতুল। পুতুলের মেয়ে প্রত্যাশার ফেসবুকে পোস্ট করা একটি ছবি জীবনের শেষবেলায় ফিরিয়ে দিল তাদের পুতুল খেলার দিনগুলো। দীর্ঘ এই ৪৭ বছরে পাল্টে গেছে অনেক কিছু। সময়ের স্রোতে বদলে গেছে সমাজ, বদলে গেছে জীবন, বদলে গেছে অনেক সম্পর্কের ধরন। তবে এত বছরের না-দেখায়ও বদলে যায়নি তাদের সম্পর্ক, বন্ধুত্ব। হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের আবার ফিরে পেয়ে যেন চিরসবুজ হয়ে উঠল বন্ধুত্বের পরবর্তী পথ। আবেগ আর খুনসুটিতে যেন ফিরে গেলেন এই শৈশবের দুরন্তপনায়। তাদের এই বন্ধুত্ব ৪৭ বছর পর ফের দেখা হওয়ার বিষয়টি একটি প্রকৃত বন্ধুত্বের উদাহরণ হয়ে থাকবে সবার মনে। উদাহরণ হয়ে থাকবে তাদের কাছে যারা মনে করে দূরে গেলে বন্ধু হারিয়ে যায়, হারিয়ে যায় বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তবে প্রকৃত বন্ধু ও সম্পর্ক কখনোই হারিয়ে যায় না। আর তাই মধ্যবয়স্কা পুতুলের বন্ধু ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক সময়কে ছাপিয়ে গিয়ে এক অমরত্ব লাভ করলো যেন এক খন্ড হীরের টুকরো। এরিস্টটলের ভাষায়, প্রত্যেক নতুন জিনিসকেই উৎকৃষ্ট মনে হয়। কিন্তু বন্ধুত্ব যতই পুরাতন হয় ততই উৎকৃষ্ট ও দৃঢ় হয়। বন্ধু শব্দটি অতি ছোট কিন্তু তার তাৎপর্য কোনো সংজ্ঞা দিয়ে বর্ণনা বা পাল্লা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। যা সাগরের মতো গভীর ও আকাশের মতো বিশাল। কথায় আছে— সৎ সঙ্গ স্বর্গ বাস, অসৎ সঙ্গ সর্বনাশ। এক বন্ধুর চারিত্রিক প্রভাব অন্য বন্ধুর উপর অবশ্যই পড়ে। তাই বন্ধু নির্বাচনে অবশ্যই সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তার সম্পর্কে অভিভাবকদের অবশ্যই অবহিত করতে হবে। তার পরিবার সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে। এজন্য সক্রেটিস বলেছেন, বন্ধুত্ব গড়তে ধীর গতি হও। কিন্তু বন্ধুত্ব হয়ে গেলে প্রতিনিয়ত তার পরিচর্যা কর। ছোট কিংবা বড় যে কোনো বয়সের মানুষের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হতে পারে। মানুষ ছাড়াও জীবজন্তু, গাছপালা ও অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে পারে। বন্ধুত্ব জাত, প্রথা, ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে। একটি বন্ধুত্বে হাত বহু অজানা ভয়কে দূর করে দেয়। বিপদে ভয়কে জয় করে অসাধ্য সাধনের সাহস যোগায়। বন্ধুত্ব হবে এমন সম্পর্ক, যে হাসিমুখে সুখে দুঃখে পাশে থাকে। শুধু যেন সুসম্পর্কের বন্ধু না হয়, বিপদে ছেড়ে পালিয়ে না যায়, দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে ফায়দা হাসিল না করে, শুধুমাত্র স্বার্থের জন্য বন্ধুত্ব না করে, বন্ধু যেন সফলতার মাপকাঠি দিয়ে যাচাই না করে। পৃথিবীর সবাই যখন নিজ স্বার্থ হাসিল করে ছুড়ে ফেলে দেবে বন্ধু পিঠে হাত রেখে বলবে আমি আছি তো। বন্ধু গুরুত্বহীন, নিরর্থক ও নিষ্প্রয়োজনয় কথাগুলো শুনবে ব্যর্থতাকে ঝেড়ে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যোগাবে। বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য সন্দেহ সংশয় ভুল বুঝাবুঝি দূর করতে হবে। সম্পর্ককে আঘাত করে কখনই বাজে মন্তব্য করা যাবে না। ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে যে কোনো ঝামেলা না বাড়িয়ে দ্রুত মিটিয়ে ফেলতে হবে। শুধু লাভের মানসিকতা ছেড়ে ত্যাগ ও ত্রাতার ভূমিকা পালন করতে হবে। জগৎ বিখ্যাত মানুষের বন্ধুত্ব নিয়ে রয়েছে নানা উক্তি, বিশ্লেষণ। যা হৃদয়ে স্থান করে রাখার মতোই। বন্ধুত্বকে পবিত্রতার নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন তারা। শব্দের শিল্প দিয়ে বন্ধুত্বকে গল্প, কবিতা আর উপন্যাসে জীবন্ত করে তুলে ধরেছেন সবার কাছে। এর মধ্যে দিয়ে বিশ্বজুড়ে বন্ধু মানেই একটি ‘পবিত্র’ শব্দ, মহৎ উচ্চারণ। আশ্রয় ও ভালোবাসার জায়গা হয়ে ওঠেছে। ইংরেজ লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফ বলেছেন, ‘কেউ কেউ পুরোহিতের কাছে যায়; কেউ কবিতার কাছে; আমি যাই বন্ধুর কাছে।’ আর আইরিশ কথাসাহিত্যিক ও সমালোচক সি জি লিউইস বলেছেন, ‘বন্ধুত্ব হল দর্শন কিংবা শিল্পকলার মতোই একটা অপ্রয়োজনীয় বিষয়...এর অস্তিত্বগত কোনো মূল্য নেই; এটা বরং এমন বিষয়গুলোর একটা যা অস্তিত্বকে মূল্যবান করে তোলে।’ মা
বাবা ভাই বোন ও আত্মীয় যারা আছে বন্ধু তাদের চাইতেও একটি ভিন্ন অনুভূতির।
অনেক বিষয় আছে যা পিতামাতা কিংবা আত্মীয়দের নির্দ্বিধায় বলা যায় না। কিন্তু
এই অব্যক্ত কথাগুলো বন্ধুর কাছে বলা যায়। নিজের দুঃখ কষ্টের এমনকি বিশেষ
সময়ের কথাগুলোও শেয়ার করা যায় সেই বিশেষ মানুষের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের ভাষায়, গোলাপ যেমন একটি বিশেষ জাতের ফুল; বন্ধু তেমনি একটি বিশেষ
জাতের মানুষ। তিনি আরও বলেছেন, ‘বন্ধুত্ব বলিতে তিনটি পদার্থ বুঝায়। দুই জন
ব্যক্তি ও একটি জগৎ। অর্থাৎ দুই জনে সহযোগী হইয়া জগতের কাজ সম্পন্ন করা।
আর, প্রেম বলিলে দুই জন ব্যক্তি মাত্র বুঝায়, আর জগৎ নাই। দুই জনেই দুই
জনের জগৎ।’ ফরাসি লেখিকা আনাইস নিন বলেছেন, ‘একেক বন্ধু আমাদের মধ্যে
একেকটা দুনিয়ার প্রতিফলন, হয়তো সে আসার আগ পর্যন্ত ওই দুনিয়াটাই জন্মায় না।
আর কেবল বন্ধুর সঙ্গে মিলনের মধ্য দিয়েই ওই দুনিয়া জন্মাতে পারে।’ দুঃসময়ে যখন কেউ আমাদের ব্যথা বুঝতে চায় না, তখনো সত্যিকারের বন্ধু আমাদের পাশে থাকে। বন্ধু মানে একই সুরে গান, বন্ধু মানে অকারণে মান-অভিমান। বন্ধু মানে হতাশার সাগরে একটুখানি আশা, বন্ধু মানে এক বুক ভালোবাসা। ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্কটির নাম বন্ধুত্ব’-এরিস্টটলের এ চিরসত্য বাক্যটির গভীরতা কতটা, তা তখনই বোঝা যায় যখন জীবনে খুঁজে পাওয়া যায় সত্যিকারের একজন বন্ধু। বন্ধুত্ব মানে বিশ্বাস, বন্ধুত্ব মানে পরস্পরের মাঝে সহযোগিতা, বন্ধুত্ব মানে বিপদে পাশে থাকা, সুখে-দুঃখে এক থাকা। জীবনের কোনো বাঁকে নয়, বন্ধুত্বের ব্যাপ্তি সারা জীবন। আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যে কেউ বন্ধু সেজে ছদ্মবেশে অনেক ক্ষতি সাধন করে থাকে। এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। সামান্য বিষয় নিয়ে বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর মনোমালিন্য হয়, সম্মান ও সম্পদ হারানো এমনকি খুন পর্যন্ত হয়ে থাকে। খারাপ বন্ধুর প্রভাবে অনেকে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। মাদক সেবন, ইভটিজিং, কিশোর গ্যাংসহ নানাবিধ অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। বন্ধু দিবসে আপনি আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে পারেন। হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে খুঁজে বের করতে পারেন। অনেক কাছের বন্ধু আছে যার সঙ্গে আপনার দীর্ঘ দিন যোগাযোগ হয় না, তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। কারো সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝি থাকলে তা মিটিয়ে নিতে পারেন। বিভিন্ন উপহার পাঠাতে পারেন। কয়েকজন বন্ধু মিলে বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে অংশ নিতে পারেন। রক্ত দিয়ে কারো জীবন বাঁচাতে পারেন। পরিবেশ রক্ষায়, এমনকি সামাজিক অপরাধ নিরসনে কাজ করতে পারেন। তবে শুধু বন্ধু হলেই হবে না, বুঝতে হবে সে প্রকৃত বন্ধু কিনা। সম্পর্কের টানাপোড়েনে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। তবে প্রকৃত বন্ধু হচ্ছে সেই যে সুখের সময় যেমন হাসিমুখে পাশে থাকে, ঠিক তেমনি দুঃখের দিনগুলোতেও লড়াইয়ের সাহস জোগায়। আপনার যে কোনো সমস্যায় যে কোনো সময় কাছের বন্ধুটি ছুটে আসবে সবার আগে। জীবনে হাতেগোনা ৪-৫ জন পাবেন যারা সাফল্য-ব্যর্থতা দিয়ে আপনাকে বিচার করবে না। সবচেয়ে ভালো বন্ধুটি হবে তাদের একজন। আপনার গুরুত্বহীন, সার্থক-নিরর্থক যত ধরনের কথা আছে, তা সবচেয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনবে সবচেয়ে কাছের বন্ধুটিই। আসলে প্রকৃত বন্ধুত্ব দিগন্ত বিস্তৃত হীরের টুকরোর মতো। লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট। ডেল্টা টাইমস্/মো. জিল্লুর রহমান/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |