বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুরবস্থা: একটি বিশ্লেষণ
রহমান মৃধা:
|
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করেছে, তবে দুর্নীতি, ভোট জালিয়াতি, এবং প্রশাসনিক অপব্যবস্থার মতো বিষয়গুলি দেশের সার্বিক অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ এবং প্রশাসনের নেতৃবৃন্দের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের বর্তমান দুরবস্থার মূল কারণগুলি বিশ্লেষণ করবে এবং একটি সমাধান প্রস্তাব করবে। ১. ভোট জালিয়াতি ও প্রশাসনের ভূমিকা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলি ব্যাপক ভোট জালিয়াতি, ভোটারদের হুমকি, এবং প্রশাসনিক অনিয়মের অভিযোগে দুষ্ট। সরকারি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই প্রক্রিয়ায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, যা গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিকে নাড়া দিয়েছে। ২. রাজনৈতিক ক্ষমতার পারিবারিকীকরণ বাংলাদেশের রাজনীতি ক্রমশ পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদগুলি পারিবারিক বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে বণ্টিত হচ্ছে। এর ফলে সুশাসনের পরিবর্তে স্বজনপ্রীতি, নৈতিক অবক্ষয় এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ৩. বিদেশি কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া সীমিত। কিছু বিদেশি কূটনীতিক ও সংস্থা নৈতিকভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই নিষ্ক্রিয়তা সরকারকে আরও বেপরোয়া করে তুলছে। ৪. সামরিক বাহিনীর নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ঐতিহাসিকভাবে দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি আস্থা কমাচ্ছে। ৫. দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অকার্যকারিতা দুর্নীতি বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোর একটি স্থায়ী সমস্যা। বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। দুর্নীতি শুধুমাত্র আর্থিক ক্ষতি করে না, এটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়িয়ে তোলে। ৬. সাধারণ জনগণের অসহায়ত্ব দেশের সাধারণ জনগণ ভোট জালিয়াতি, দুর্নীতি, এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে সরব হলেও কার্যকর প্রতিকার পাচ্ছে না। রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের বিশ্বাসকে নষ্ট করছে। ৭. কোটা আন্দোলন ও শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা কোটা আন্দোলন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বিশাল নৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছে। শিক্ষার্থীরা দেশের সার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, যা দেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই আন্দোলন জাতির সামনে একটি নতুন আশার আলো জ্বালিয়েছে। ৮. ঐক্য ও প্রতিরোধের আহ্বান দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে একটি সোনার বাংলা গড়ার জন্য। স্বাধীনতার সংগ্রামের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে হবে। মরতে তো হবেই, কিন্তু বীরপুরুষের মত মরার মাঝে যে পবিত্রতা রয়েছে, সেটা তো ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেঁচে থাকা এবং পরে পালিয়ে বেড়ানো বা বাকি জীবন জেলে কাটানোর চেয়ে অনেক বেশি সম্মানজনক। ৯. পরিণাম ও করণীয় বর্তমান অবস্থার পরিবর্তনে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে: - গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির পুনর্গঠন: স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন। - দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ: দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন। - সামরিক বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা: সামরিক বাহিনীর পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা। - আন্তর্জাতিক সমর্থন ও নজরদারি: বিদেশি কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির কার্যকর ভূমিকা। - শিক্ষার্থীদের নৈতিক চেতনাকে সমর্থন: শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সমর্থন করে এবং তাদের দাবি পূরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক দুরবস্থার পেছনে বহুমুখী কারণ রয়েছে। এর সমাধানে সুশাসন, গণতন্ত্র এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতার প্রতি প্রতিশ্রুতি গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ জনগণের শক্তি ও সচেতনতা বৃদ্ধি করে, এবং আন্তর্জাতিক মহলের কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করে বাংলাদেশের জন্য একটি উত্তম ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা সম্ভব। এই পথে নারী-পুরুষ সকলকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিজেদের উজাড় করে দিতে হবে। লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। ডেল্টা টাইমস্/রহমান মৃধা/সিআর |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |