বিলুপ্ত হচ্ছে এনটিআরসিএ, অব্যবস্থাপনায় বঞ্চিতদের ভবিষ্যৎ কী?
আমির আসহাব:
|
২০০৫ সালে গঠিত হয় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে এনটিআরসিএ’র কাজ ছিল শুধু প্রত্যয়ন প্রদান করা, শিক্ষক নিয়োগ হত ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ করে এনটিআরসিএ-কে নিয়োগ সুপারিশের অনুমতি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের নামে দুর্নীতি (স্বজনপ্রীতি ও ষুষ বাণিজ্য) বন্ধ হওয়া নিঃসন্দেহে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। স্নাতক-মাস্টার্স করা তরুণ-তরুণীরা নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে ‘নিবন্ধন সনদ’ অর্জন করেছে এবং শিক্ষক হিসেবে শুধু তাদেরকেই নিয়োগ দেওয়া হবে। কাজেই শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কাজটা স্বচ্ছ এবং সহজ হওয়ার কথা। স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করলে এনটিআরসিএ’র কর্মযজ্ঞ যথাযথ ও যৌক্তিক মনে হবে। কারণ এনটিআরসিএ এযাবৎ প্রায় এক লক্ষ শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন করেছে। ১-১২তমসহ সদ্য উত্তীর্ণ ১৭তমদের মধ্যে শুধু ৩৫ ঊর্ধ্বরা এনটিআরসিএ’র অব্যবস্থাপনার শিকার। বর্তমানে এমপিও নীতিমালা অনুসারে ৩৫ঊর্র্ধ্বদের শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। অথচ পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণকালে কারও বয়স ৩৫ ঊর্র্ধ্ব ছিল না। যথেষ্ট শূন্যপদ থাকার পরও এমপিও নীতিমালা অনুসারে নিদির্ষ্ট সময়সীমার মধ্যে সুপারিশ করতে না পারার অদক্ষতা বা অপারগতার দায় নিশ্চয় নিবন্ধিতদের নয়। শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশের অনুমতি দেয়ার পর স্বাভাবিকভাবে পরের দিন থেকে এনটিআরসিএ নিয়োগ দেবে এমনটাই স্বাভাবিক। হাইকোর্টের নির্দেশে উত্তীর্ণদের সম্মিলিত তালিকা প্রকাশিত হয়। ১-১২তম, বিশেষ ১০তম এবং ১৩তমদের নিয়ে জাতীয় মেধাতালিকা প্রকাশ করে এনটিআরসিএ। গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে অবশ্যই মেধাবীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ পেশায় সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকা উচিত। আসলেই কি এনটিআরসিএ প্রকৃত মেধাবীদের শনাক্ত ও মূল্যায়ন যথাযথ করেছে? প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক আবেদনের বিপরীতে সুপারিশ কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায়, কেউ কেউ ৪০ মার্কেও চাকরি পেয়েছে, আবার কেউ কেউ ৮০ মার্ক পেয়ে হয়েছেন নিয়োগ বঞ্চিত। এন্ট্রিলেভেলের শিক্ষকদের সাথে ইনডেক্সধারী (ইতোমধ্যে এমপিও প্রাপ্ত) শিক্ষদের আবেদনের সুযোগ রাখায় ইনডেক্সধারী শিক্ষক দ্বারা অধিকাংশ পদই পূরণ হতো। ফলে ইনডেক্সধারীরা নতুন শূন্যপদে যোগদান করলে আগের পদটি শুন্য হতো, আর অপেক্ষাকৃত ভালো পদ মনে না করলে, যোগদান না করলে শূন্য পদ শুন্যই থাকত। হাজার-হাজার শূন্য পদে বিপরীতে (ঋণ করে, সম্পতি বিক্রি করে, গহনা বন্ধক রেখে) আবেদন করে লাখ লাখ টাকা খরচ করে নিবন্ধিতরা হয়েছে সর্বস্বান্ত। ১-১২তমদের (এন্ট্রিলেভেল মার্ক-৪০ পেলেই নিয়োগ যোগ্য বিবেচিত হওয়ায়) বেশি নাম্বারের প্রতি করো তেমন আগ্রহ ছিল না, ফলে নব্বইভাগেরই অবস্থান তালিকার পিছনের দিকে। অপরদিকে সুপারিশ প্রক্রিয়া এনটিআরসিএ’র হাতে আসায় ১৩তম, ১৪তম, ১৫তম, ১৬তমরা প্রতিযোগিতা করে বেশি নাম্বারসহ উত্তীর্ণ হয়ে সুপারিশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগায়। ১-১২তমরা ক্ষতিগ্রস্থ ও নিয়োগ সুপারিশ বঞ্চিত হতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আদালতের দ্বারস্ত হয়ে রিট করেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশে, সনদের মেয়াদ পাঁচ বছর বাক্যটি বিলুপ্ত করে, আজীবন করা হয় এবং কেননা মহামান্য রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ এবং ১২ জুন ২০১৮ তারিখের আগে যারা নিবন্ধন সনদ পেয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের ৩৯০০/২০১৯ রায় অনুযায়ী বয়সসীমা শিথিলযোগ্য। ৫ম গণবিজ্ঞপ্তিতে (শিক্ষক নিয়োগের জন্য আবেদনের আহবানে) এসে দেখা গেল, পূর্বে নিবন্ধন সনদ প্রাপ্ত প্রার্থীরা আর আবেদন করতে পারছে না। উল্লেখ্য যে, আবেদন গ্রহণ প্রক্রিয়া অনলাইনে সম্পন্ন করা হচ্ছে। ওয়েবসাইট শর্ত মোতাবেন কন্ট্রোল করা হচ্ছে। শর্তটি হচ্ছে- এমপিও নীতিমালা-২০১৮ অনুসারে প্রার্থীর বয়স সর্বোচ্চ ৩৫ বছর এবং সনদের মেয়াদ তিন বছর। শর্তটি ১-১২তমদের জন্য প্রযোজ্য হওয়ার কথা না, বিষয়টি উল্লেখ করে এনটিআরসিএ তৃতীয়গণবিজ্ঞপ্তিতেও আবেদন গ্রহণ করে এবং নির্বাচিতদের নিয়োগ সুপারিশ করে। এমপিও নীতিমালা প্রবর্তন পরবর্তিদের জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলে তা পরবর্তিদের জন্য প্রযোজ্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। অপরদিকে ১৭তমদের একাংশ নিবন্ধন সনদ পেয়ে একবারও নিয়োগ সুপারিশ কার্যক্রমে অংশ গ্রহণে সুযোগ না পেয়ে বয়সের সীমাবদ্ধতায় হল বঞ্চিত। নিবন্ধিত নিয়োগ বঞ্চিত শিক্ষকেরা একত্রিত হয়ে আবেদনের সুযোগ চেয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করল। ১-১২তম নিবন্ধিত সনদধারী শিক্ষকের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে নিয়োগ জন্য আন্দোলন করছে। আরও আন্দোলন করছে বদলী প্রত্যাশী (ইতোমধ্যে এমপিও প্রাপ্ত) ইনডেক্সধারী শিক্ষকরা। অনেকে ইতোপূর্বে করেছে, আবার অনেকে নতুন করে করছেন রিট মামলা। কেন-ই বা এনটিআরসিএ’র নামে হাজার হাজার মামলা-মোকদ্দমা? ২০১৬ সালে এনটিআরসিএ ১৬০০০ পদের বিপরীতে প্রথম গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। প্রার্থীরা নিজ জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করেন। কিন্তু পদ্ধতিগত ভুলের কারণে একই ব্যক্তি একাধিক প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে মোট ৩৯ হাজার ৫৩৫টি শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যে দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন এনটিআরসিএ। দ্বিতীয় নিয়োগ চক্রে চূড়ান্তভাবে প্রায় ৩৪ হাজার শিক্ষক দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুপারিশ পেলেও বেশিরভাগ ছিল ইনডেক্সধারী। ২০২০ সালের ৩১ মার্চ প্রায় ৫৪ হাজার ৩০৪ টি পদের বিপরীতে প্রকাশ করা হয় তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি। ঐ একই বদলি ব্যবস্থা না থাকায় দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত ইনডেক্সধারী শিক্ষকসহ এন্ট্রিলেভেল শিক্ষক নিয়োগ আবেদন করেন তৃতীয় নিয়োগ চক্রে। তৃতীয় চক্রে জয়েন করেন (ইনডেক্সধারী ব্যতিত) মাত্র ১২ হাজারের মতো। পদ শূন্য থাকে প্রায় ৪০ হাজারের উপরে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের নিয়োগের নামে (হাজার-হাজার আবেদনে সুপারিশের সম্ভাবনার প্রলোভন দেখিয়ে) এনটিআরসিএ’র পদ শুন্য রাখা ও ক্যাসিনো খেলার চরম রসিকতার বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২০০ দিন প্যানেল প্রত্যাশী নিবন্ধিত শিক্ষক সংগঠন আন্দোলন চালিয়ে যায়। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় এমনকি সিত্রাং-এর মতো প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মাঝেও আন্দোলন চলমান থাকে। সরকার দলীয় এমপি-মন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা বিষয়ক স্থায়ী কমিটিসহ দায়িত্বশীলদের বিষয়টি অবগত করা হয়। মহান জাতীয় সংসদে বিষয়টি বারবার উপস্থাপিত হয়। তবু টনক নড়ে না কারো। অবশেষে ২০০তম দিন ২১ ডিসেম্বর, ২০২২ নিবন্ধিত নিয়োগ বঞ্চিত শিক্ষকেরা শাহবাগ অবরোধ করে। শাহবাগ মোড় সাড়ে চার ঘন্টা পর তৎকালিন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি ফোন করে আলোচনায় বসতে আগ্রহ জানায়। ০২ জানুয়ারি ২০২৩ আলোচনায় এনটিআরসিএ ও সাবেক মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী - এক আবেদনে নিয়োগ ও ইনডেক্সবিহীন আবেদন, এই দুইটি দাবি মেনে নেয়। শিক্ষক নিবন্ধন সনদ, শিক্ষকতা ছাড়া অন্য কোনো কাজে আসবে না। এছাড়াও এন্ট্রিলেভেল শিক্ষকদের সাথে ইনডেক্সধারীদের আবেদনের সুযোগ থাকলে স্বাভাবিকভাবেই ইনডেক্সধারী কর্তৃক অধিকাংশ পদ পূরণ হয়, এন্ট্রিলেভেল শিক্ষক বঞ্চিত হয় এবং কৃত্রিম শিক্ষক সংকট তৈরি হয়। আলোচনার বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষক নিয়োগের অনুসরণীয় প্রদ্ধতির ৭ নং পয়েন্ট (ইনডেক্সধালীদের আবেদনের সুযোগ) স্থগিতের মাধ্যমে এন্ট্রিলেভেলের শিক্ষক দ্বারা সকল পদ পরণেরও প্রতিশ্রুতি দেন। নিয়োগ আবেদনেরও পরিবর্তন আনে এনটিআরসিএ। একজন প্রার্থী স্কুল-কলেজ এই দুই লেভেলের জন্য দুইট আবেদন করতে পারবেন এবং প্রত্যেক আবেদনের বিপরীতে চল্লিশটি প্রতিষ্ঠান চয়েস থাকবে। কেউ কলেজ নিবন্ধনের বিপরীতে নির্বাচিত না হলে স্কুলে বিবেচনা করা হবে। এই দুইটি প্রক্রিয়ায়ও যদি নির্বাচিত না হয় তবে, শূন্যপদ থাকা সাপেক্ষে সারা বাংলাদেশের যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে ইচ্ছু হলেও থাকবে ‘‘ইয়েস অপশন’’। কিন্তু চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির পর দেখা গেল, ৬৮ হাজার শুন্য পদে প্রাথমিক সুপারিশ পেল মাত্র ২৭ হাজার, চূড়ান্ত নিয়োগ পেল আরও কম। আবারও পদ ফাঁকা থাক ৪০ হাজারের উপরে। তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করা ছিল কিন্তু সুপারিশ করা হয়নি এমন কিছু তথ্য শিক্ষামন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হলে এনটিআরসিএ ব্যবস্থা নিবে জানিয়ে ছিলেন। অথচ এনটিআরসিএ তো কোনো ব্যবস্থাই নেননি বরং প্রার্থীকে হুমকি দিয়ে বিষয়টি চেপে গেছেন। আবার চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতেও একই অবস্থা। ধরা যাক- ‘ক’ নামক ব্যক্তি স্কুল ও কলেজ উভয় নিবন্ধনের বিপরীতে আবেদন করেছে। ‘ক’-এর আবেদনকৃত কলেজ শাখার ৯টি প্রতিষ্ঠান এবং স্কুল শাখার ১১ টি প্রতিষ্ঠানে আবার ৫ম গণবিজ্ঞপ্তিতেও আবেদন নেওয়া হয়েছে। এ রকম গল্প শুধু ‘ক’-এর একার নয়। এভাবে হাজার-হাজার নিবন্ধিত শিক্ষক বারবার নিয়োগ বঞ্চিত। চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন ছিল অথচ পদ পূরণ করা হয়নি- এমন নিয়োগ বঞ্চিতদের ৬২০১/২৪ মামলার রায় ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার নিদের্শনা না মেনেই ৫ম গণবিজ্ঞপ্তির ফল প্রকাশিত হল। ৫ম গণবিজ্ঞপ্তিতেও সিদ্ধান্তগত ও সিষ্টেম জনিত ত্রুটির কারণে ফাঁকা থাকছে প্রায় ৮০ হাজার পদ। তাহলে কি দাঁড়াল, প্রতি গণবিজ্ঞপ্তিতে এক-পঞ্চমাংশ পদ ফাঁকা থাকছে, নাকি রাখা হচ্ছে? পদ ফাঁকা থাকুক বা রাখা হোক, আবেদন করেও যারা সিষ্টেম বা সিদ্ধান্তগত কারণে নিয়োগ বঞ্চিত তাদের তাদের বয়স কী থেমে থাকবে? তাছাড়া নিবন্ধিতদের এন্ট্রিলেভেন বয়স কেন বিবেচ্য নয়, সেটা বড়ই রহস্যজনক। ৫ম গণবিজ্ঞপ্তিতে ৯৭ হাজার পদের বিপরীতে আবেদন পড়েছে মাত্র ২২ হাজার, প্রাথমিক সুপারিশ হয়েছে মাত্র ২০ হাজার এর মতো, এখন ভি-রোল ফরম পূরণ হচ্ছে, পুলিশ ভেরিফিকেশনও শুরু হয়নি। অথচ মহান জাতীয় সংসদে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষাক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কে সংসদ সদস্যদের বিভিন্ন প্রশ্ন জবাবে বললেন- গত ৬ মাসে ৯৯ হাজার (শুন্যপদ ৯৭) শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন করেছে এনটিআরসিএ। এতে এটা স্পষ্ট যে, শিক্ষামন্ত্রণালয় ও এনটিআরসিএ’র মধ্যে তথ্য বিভ্রান্তি প্রকট অথবা রয়েছে চরম উদাসিনতা। প্যানেল প্রত্যাশী নিবন্ধিত শিক্ষক সংগঠনের ব্যানারে আন্দোলনের সময় বেশ কিছু পত্রিকায় চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসে। এনটিআরসিএ’র চেয়ারম্যানের ড্রাইভার, সিষ্টেম অ্যানালিস্ট টাকার বিনিময়ে উচ্চমার্কের সনদ প্রদান করে, আবার চাকরিও পাইয়ে দেয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লিখিতভাবে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অর্জনের আহব্বান করেছেন। পাঠ্যপুস্তকে তিনি লিখেছেন- ‘‘সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য যোগ্যতা অর্জন কর। যোগ্যতা অর্জন করে যদি পদ্ধতিগত সমস্যা, সিদ্ধান্তগত সমস্যা এবং কতিপয় অসাধু ব্যক্তির সংঘবদ্ধ চক্র ও অবৈধ সনদের সহজলভ্যতায় যোগ্যরা যথাস্থানে স্থানে যেতে না পারে তবে, যোগ্যতা অর্জনের মানে কী? গণিত, ইংরেজি ও বিজ্ঞান বিষয়ে নিবন্ধিত আদর্শ ও যোগ্য শিক্ষকের অভাব না থাকলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৮৫% শিক্ষকেরই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর নেই কেন? এন্ট্রিলেভেলের শিক্ষকদের সাথে ইনডেক্সধারীদের সুযোগ দিয়ে, বারবার পদ ফাঁকা রেখে, একটি জাতীয় দৈনিকে (‘‘রিটে না মেরিটে’’ শিরোনামে) প্রকাশিত প্রতিবেদনে রিট মামলায় অংশগ্রহণকারীদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে, জাল সনদ প্রদানকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে, সিষ্টেমজনিত ত্রুটির কারণে সব শর্তে উত্তীর্ণ নিবন্ধিত শিক্ষকদের একটা (১-১২তম) অংশের সাথে প্রকান্তরে প্রতারণা করেই যাচ্ছে এনটিআরসিএ। গত ১১ জুলাই এনটিআরসিএ সংবাদ সম্মেলন করে জানালো যে, নিবন্ধিতরা তাদের বিরুদ্ধে মাঠে অযৌক্তিক দাবিতে আন্দোলন করছে এবং বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে? পাল্টা প্রশ্ন আসতেই পারে- শিক্ষামন্ত্রী মহান সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামনে বললেন গত ৬ মাসে ৯৯ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে এনটিআরসিএ- এ অসত্য তথ্য তাকে কে সরবরাহ করল। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী বরাবরই বলে আসছেন, শিক্ষক নিবন্ধন সনদ নূন্যতম যোগ্যতার সনদ। এ সনদ চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান করে না। তার কথার প্রতি যথার্থ সম্মান রেখে বলতে চাই, ২২০৭ জনকে কোন আইনে এক আবেদনে পদ সংরক্ষণ করে নিয়োগ দেওয়া হলো? চতুর্থ এমপিও নীতিমালার বাইরেও ১-৫ম ব্যাচের ৪৪০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হলো কোন আইনে? জনশ্রুতি আছে এনটিআরসিএ’র নিবন্ধিতদের ৬০ হাজার সনদ-ই জাল। জাল সনদধারী ১১৬৫ জনের বেতন-ভাতা ফেরত দিতে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার, কিন্তু তারা নিয়োগ পেল কিভাবে? সবচেয়ে বড় কথা প্রতিবার পদ ফাঁকা রেখে নিবন্ধিতদের বঞ্চিত করা হলো কার স্বার্থে? নিয়োগ যদি না-ই-দিবে তবে নিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে কেন হাজার-হাজার আবেদনের বিপরীতে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া সুযোগ পেল এনটিআরসিএ? ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করে নিবন্ধিত শিক্ষকদের একটা অংশের সাথে এনটিআরসিএ’র নিয়োগের নামে দুরসন্ধিমূলক কাজ করার পেছনের শক্তির উৎস কী? নিয়োগ সম্ভব বলেই মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব সরোজ কুমার নাথ স্যার প্যানেল প্রত্যাশী নিবন্ধিত শিক্ষক সংগঠনের নিয়োগ বঞ্চিতদের ২১৭৯৬ জনের একটি তালিকা গ্রহণ করেছিলেন। সরকার-কে মনে রাখতে হবে, গুটি কয়েক অসাধু ব্যাক্তি বা সিন্ডিকেটকারীর স্বার্থে নিবন্ধিত শিক্ষক, শিক্ষাব্যস্থা ও কচিকাঁকা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে পারে না। রাষ্ট্রের উদাসীনতায় নাগরিক অধিকার হরণ হলে, জাতীর জন্য অশনি সংকেত অপেক্ষা করছে। সুতরাং আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও জাতীয় স্বার্থে পুনঃবিবেচনা করার এখনই সময়। স্বঘোষিত বা অবৈধ সনদের ডাক্তার থেকে রোগীর মৃত্যু ব্যাতিত যেমন ভালো কিছু আশা করা য়ায় না। তেমনি অবৈধ সনদধারী শিক্ষক নামের অমানুষগুলো ব্যাক্তি স্বার্থে-ই শিক্ষাক্ষেত্রকে কুলষিত করছে এবং করবে। অনৈতিক সুবিধা ভোগীদের জন্যই ফেসবুকের ভাইরাল পোস্ট- ‘‘শিক্ষক তোমার আদশ কই?’’। প্রশ্নফাঁস বা অবৈধ সনদের উৎস এবং কৃত্রিম শিক্ষক সংকটে জড়িত অসাধু ব্যক্তির ব্যাপারে কঠোর ও যথাযথ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ব্যবস্থা না নেওয়া হলে, কচিকাঁচা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এনটিআরসিএ’র ওয়েব সাইটে নিবন্ধিত সনদধারীর সংখ্যা ৬ লক্ষাধিক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বারবার চাহিদা দিয়েও শিক্ষক পাচ্ছে না। ফলে অ্যাডহক শিক্ষক নিয়ে কোনো মতে চলছে অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অ্যাডহকদের মধ্যেও অনেকেরই রয়েছে বিস্তর অভিজ্ঞতা, সরকারি প্রশিক্ষণ, এমএড-বিএডসহ শিক্ষক নিবন্ধন সনদ। প্রকান্তরে তারাও হচ্ছেন বৈষ্যমের শিক্ষার। চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে স্কুল ও কলেজ পৃথকভাবে আবেদন পড়ে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার এবং স্কুল-কলেজ মিলে (যেহেতু একজন ব্যাক্তি একাধিক পদে চাকরি করার কোনো সুযোগ নেই। প্রকৃত চাকরি প্রত্যাশীর সংখ্যা হিসেবে) আবেদন পড়েছিল ৮১ হাজার। বর্তমানে শূন্যপদ ৯৭ হাজার। শিক্ষক সংকট দূর করতে সরকার বছরে চারবার শিক্ষক নিযোগের কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। এনটিআরসিএ’র হাতে পর্যাপ্ত শিক্ষকও আছে। দীর্ঘদিন ধরে শোনা যাচ্ছে শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা আনতে কমিশন ( এনটিএসআরআরএ) গঠন করবে সরকার। ভালো কিছু হলে ক্ষতি কী? কিন্তু তারও আগে, এনটিআরসিএ’র অব্যবস্থাপনায় যারা বারবার বঞ্চিত, যাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে, তাদের আইনগত অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হোক। একটি খারাপ সিস্টেম দ্বারা সব সময় ভালো মানুষগুলো পরাজিত হয়। সুতরাং ১ম থেকে ৫ম গণবিজ্ঞপ্তিতে এযাবৎ আবেদনকারী অথবা স্ব স্ব নীতিমালায় একটি মাত্র ই-আবেদন নিয়ে বিষয়ভিত্তিক ব্যাচ ধরে ধরে প্যানেলে নিয়োগ দেওয়ার সদিচ্ছাই হতে পারে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের শ্রেষ্ঠ উপায়। অন্যথায় নিবন্ধিত শিক্ষকেরা শুধু বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্থ হবে তা নয়, ক্ষতিগ্রস্থ হবে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা। লেখক : সভাপতি, প্যানেল প্রত্যাশী নিবন্ধিত শিক্ষক সংগঠন। ডেল্টা টাইমস/আমির আসহাব/সিআর/এমই
|
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |