নেতৃত্বের ভুলে জনগনের খেসারত
আশরাফুল আলম
|
![]() . আমরা মানুষ সামাজিক জীব। আর সমাজের বিভিন্ন চড়ই উতড়াই অতিক্রম করেই সুষ্ঠ সামাজিক বন্ধনের মাধ্যমেই জীবন পরিচালনা করি। যেকোন প্রতিষ্ঠানের বা দলের যোগ্য নেতৃত্বের পরিপূর্ণতায় সফলতা আসে। যুগযুগ ধরে পৃথিবীতে ভূল নেতৃত্বের কারনে যেমন মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তেমনি যোগ্য নেতৃত্বের কারনেই অনেক বড় বড় সাফল্য অর্জিত হয়েছে এবং মানুষ তা উপভোগ করেছে। সঠিক নেতৃত্বের কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যেমন অর্জিত হয়েছে ঠিক তেমনি এই অর্জনকে ধরে রাখতে প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্বের সবটুকু নিঃস্বরণ। নেতৃত্বের গড়িমসি হলে চরম দুর্বিপাকে পরে দেশের মানুষ এবং দেশের ক্ষয়-ক্ষতি বাড়িয়ে জনগনের উপর চাপ বৃদ্ধি করে। সুতরাং তখন জনগনই হয়ে ওঠে খেসারতের মুল কেন্দ্রবিন্দু। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিগত কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস ঘাটলেই ভালো মন্দ দুই ধরনের নেতৃত্বের সংমিশ্রণ চোখে পরে যায়। যারা সরাসরি রাজনীতি কিংবা প্রতিষ্ঠান বা দল পরিচালনা করি তাদের বাহিরে যারা বাস করে তারা কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারে কোন নেতার কি কি দুর্বলতা আর কে কতটুকু রাজনীতি পরিচালনায় যোগ্য। আমরা দেখি যার রাজনীতিতে ভিত্তিটুকুও নেই মানে সারাজীবন সরকারি চাকুরি করে টাকার পাহাড় গড়েছেন তারাই আবার চাকুরি শেষে দলের স্নেহ ভাজন হয়ে নতুন করে জনসেবায় নেমে আসছেন। অথবা ব্যবসা বাণিজ্য করে টাকা কামিয়ে বুড়ো বয়সে সংসদের চেয়ারের জন্য রাজনীতির মঞ্চে উপবিষ্ট। এই তালিকার মধ্যে রয়েছেন অবসর প্রাপ্ত চাকুরে, খেলোয়ার, নায়িকা- গায়িকা, ইউটিউবারসহ বিভিন্ন পেশার ভিত্তিহীন শুণ্য নেপথ্য রাজনৈতিক নেতা। তার মানে হলো প্রায় ৪০ বছর জনগনের সেবার দায়িত্ব নিয়েও পরিপূর্ণ সেবার ঘাটতি মেটাতে বুড়ো বয়সে নেমেছেন ভোটের মাঠে। আসলে এটা সত্যিকারের নেতৃত্ব দেবার নিমিত্তে না কি অন্য কোনো ফায়দা লুটতে, সন্দেহ কিন্তু যায় না। তবে বিগত অভিজ্ঞতায় বলে, যতটা না নাগরিক সেবা তার চেয়ে বেশি নিজ নিজ বিলাসী জীবন আর ক্ষমতার দাপটে চড়ে বেড়ানোর একটা কৌশল মাত্র। যারা ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট কিংবা রাজনীতির উপর পড়া লেখা করে স্বপ্ন দেখেন নিজ মাতৃভুমিকে সোনার বাগানে রুপান্তর করতে তারা অর্থ আর খোলস পড়া দাপুটে নেতৃত্বের কাছে পারাজিত সৈনিক। দুই এক জন জেগে উঠলেও বেশিরভাগই থাকেন সক্রিয়তা থেকে অনেক দুরে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে গুটি কয়েক নেতার ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভরকরে তাদের জীবনের চলার পথ। তাদের রাজনীতি কোনদিকে যাবে বা জীবনের গতি কোন দিকে পরিচালিত হবে তা নির্ভর করে তার নেতার মেজাজ মর্জির উপর। কথা হলো একজন যোগ্য নেতা গড়ে উঠতে বিশেষ কিছু গুনাগুণ প্রয়োজন হয়। একজন মানুষ যখন তার সব সম্ভাবনা প্রকাশ করতে পারে তখন তার নেতৃত্বের বহিঃ প্রকাশ ঘটে। নেতা হওয়ার জন্য একজন মানুষের যেসকল গুণাবলির প্রয়োজন হয় তা হলো- দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, পারিপার্শ্বিক পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা থাকা, নেতৃত্ব চর্চার অভিজ্ঞতা থাকা ইত্যাদি। নেতৃত্ব দেয়ার প্রথম শর্তই হচ্ছে সবার আগে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে জানতে হবে। বাঙ্গালী জাতি সত্তার যোগ্য নেতৃত্বের উদাহরণ হয়ে পৃথিবীর বুকে মাথা উচুঁ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, তিতুমীর, খুদিরাম বসু, সুর্যসেন, মঙ্গল পান্ডে, বিনয় বাদল দীনেস, সুবাস চন্দ্র বোস, মওলানা ভাসানী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ নাম না জানা অনেক ব্যক্তিত্ব। বর্তমান পরিস্থিতিতে পুরো পৃথিবীই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে বলে মনে করা হয়। কারণ আমরা পৃথিবীতে এক ধরনের আগ্রাসী নেতৃত্বের বহিঃ প্রকাশ দেখছি। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ, প্যালেষ্টাইন ও ইসরাইল, আফগানিস্থান, উত্তর কোরিয়া, চীন জাপান, আমেরিকাসহ অনেক দেশেই চলছে আগ্রাসী কৌশলের প্রতিযোগীতা। নেতাদের শাসনের নামে চলছে শোষনের মহাউৎসব। রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে অসুস্থ্য প্রতিযোগিতার কারণে নাগরিকের জীবন নিরাপত্তা আজ হুমকির মুখে। প্রতিহিংসা ও পীড়ন হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রনীতির মাঠ। মামলা হামলার মাধ্যমে একে অপরকে দমনের নেশায় মত্ত। রাজনীতিক বাক্যালাপেও দেখা যাচ্ছে কুরুচিপূর্ণ ইশ্বানিত কথন। আলোচনা সমালোচনার ঝড়ে অনেক নেতৃত্ব নিয়েই পৃথিবীজুরে বইছে মিডিয়া ঝড়। এমন ঝড়ে কে সঠিক কে বেঠিক বোঝা বড় দায়। হুংকার দিয়ে নেতৃত্ব পরিচালনা হলেও জীবনের স্বাধীনতা আর শৃঙ্খল পরিবেশ কেউ উপহার দিতে ব্যার্থ হচ্ছে। ফলে সঠিক নেতৃত্বে অভাবে সীমাহীন খেসারতের ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন ‘‘ নেতারা যদি নেতৃত্ব দিতে ভুল করে, জনগনকে তার খেসারত দিতে হয়’’। যোগ্য নেতৃত্বের অভাব এবং নেতৃত্বের দুর্বৃত্ত্যায়নে সমাজে ও প্রতিষ্ঠানে ঘুষ, দুর্নীতি, নারী নির্যাতন, প্রতারণা, চুরি, ডাকাতি, সাইবার ক্রাইম, সাইবার বুলিং, দ্রব্যমূল্য উর্ধ্বগতি, আর্থিক সংকট, পণ্য সরবরাহে ঘাটতি, বিভিন্ন জ্বালনি ও সেবার দাম বৃদ্ধি, অথবা ভাড়া বৃদ্ধিসহ নানা অসঙ্গতি দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। রাজনীতির মাঠে একে অপরকে ঘায়েল করতে নাগরিক সেবার বালাই দমন হচ্ছে। কেউ খেলার ডালি, কেউ গানের ডালি কেউবা অভিনয়ের ডালি গুছিয়ে রাজনীতির মাঠে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় অশ্ব দৌড়ে ব্যস্ত। ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, স্থাপত্য শিল্প, আমদানী-রপ্তানী শিল্প, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, সুশাসন, নাগরিকসেবাসহ সকল ক্ষেত্রে শৃঙ্খলার ব্যাপ্তয় ঘটে। নেতৃত্বের দায়িত্বভার হস্তান্তর অথবা বিভাজন করে বুঝিয়ে দেবার পরে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা বেশির ভাগই কিন্তু পরবর্তী প্রেক্ষাপট নিয়ে সঠিক মনিটরিং এ থাকেন না কারণ তারা তখন তেলের সাগরে ভাসতে থাকেন। তাদেরকে বিভিন্ন উপায়ে তেল দিয়ে আর চোখে কালো চশমা দিয়ে অন্ধের জগতে রাখা হয়। নেতারাও যে অন্যায় করতে পারে তেল খাওয়া ব্যক্তির নিকট তা বিশ্বাসই হতে চায় না। প্রতিষ্ঠান বা দল দুর্নীতিপরায়ণ ও কুলশিত নেতৃত্বের কবলে পরে জনগনের খেসারত বাড়িয়ে তোলে। বিশেষ কোন লক্ষ্য অথবা উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাজকে অথবা তাদের আচরণকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে নিয়ে আসার ক্ষমতাকেই নেতৃত্ব বলা হয়। আর এই নিয়ে যাওয়ার কাজটি যিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে করে থাকেন তিনিই হলো নেতা। নেতা হওয়ার কিছু যোগ্যতা লাগে যেমন- সততা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, আত্মবিশ্বাসী ও সহসী, ঝুঁকি গ্রহনের ক্ষমতা, যোগাযোগ দক্ষতা, বিষয় ভিত্তিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, সহযোগী মনোভাব, সাংগঠনিক দক্ষতা, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সক্ষমতা ইত্যাদি। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় যারা নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন তাদের অনেকেরই ব্যক্তিগত জীবনের যে বিশ্লেষণ তাতে দেখা যায়, অনেকেরই মধ্যে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ বিভিন্ন ধরনের অপরিহায্য বৈশিষ্ঠ্যের যথেষ্ট অভাব। এমন পরিস্থিতির অবসান হোক, পরিস্থিতির উন্নতি হোক জনগনের সঠিক সেবা সুনিশ্চিত হোক এই প্রত্যাশায় শেষ করছি। লেখক: উন্নয়ন কর্মী, গাইবান্ধা। ডেল্টা টাইমস্/সিআর/এমই
|
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |