টেকসই উন্নয়নে রেলের ভূমিকা অপরিসীম
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() টেকসই উন্নয়নে রেলের ভূমিকা অপরিসীম কিন্তু এসব পদক্ষেপে রেলসেবার মান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেনি। কারণ ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা।রেলকে সেবামূলক খাত বলা হলেও সেবা বাড়েনি। বরং ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়, জনবল সংকট, বারবার রেল দুর্ঘটনা, টিকিট কালোবাজারি, প্রকল্পে ধীরগতি এবং নানা ধরনের দুর্নীতি, রেলের বগি অপরিষ্কার, বাথরুমে পানি-আলো না থাকা, ট্রেনের সিট ভাঙা, বিনা টিকিটের যাত্রীদের দৌরাত্ম্য ইত্যাদি কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবার মান বাড়ছে না। রেলে গত কয়েক বছরে যে পরিমাণ বিনিয়োগ ও প্রকল্প নেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নের মতো দক্ষ কর্মকর্তার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, যাত্রী সুবিধা বা আয়বর্ধক প্রকল্প না নিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ কেনাকাটার প্রকল্প নেয়া। প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে পরিকল্পনার যে অভাব রয়েছে তা রেলওয়ের যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের চিত্র থেকেই স্পষ্ট। অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ দেয়ায় গুরুত্ব হারাচ্ছে প্রধান কাজগুলো। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল আধুনিক ও মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিতে ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে পদক্ষেপ নেয়া। তা না করে গৌণ কাজে বেশি অর্থ ও সময় ব্যয় করা হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও সেবার মানে উন্নতি না হওয়ার পেছনে এটিও একটি কারণ। রেলওয়েতে বিগত সময়ে বিনিয়োগ বাড়লেও তা সুপরিকল্পিত হয়নি। ২০০৯ সাল থেকে রেলের উন্নয়নের পেছনে ৭২ হাজার কোটি টাকা খরচের কথা বলা হলেও তার কতটুকু মৌলিক কাঠাগোমগত সমস্যা সমাধানে কাজে লেগেছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এই খরচের বড় অংশই গেছে নতুন রেললাইন ও স্টেশন ভবন নির্মাণের পেছনে। পুরোনোগুলো মেরামতের চেয়ে নতুন লাইন নির্মাণে বেশি ব্যয় করা হয়েছে। হাজার কোটি টাকার নতুন রেললাইন দিয়ে নামেমাত্র ট্রেন চালানো হচ্ছে। পর্যাপ্ত ইঞ্জিন ও কোচের ব্যবস্থা না করেই একের পর এক নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। স্টেশন ভবন নির্মাণের পর লোকবলের অভাবে সেগুলো চালানো যাচ্ছে না। সময়ের ব্যবধানে ৮৪টি ইঞ্জিন ও ৫২০টি কোচ কেনা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যেগুলো কেনা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে নানান অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আছে। এসব খতিয়ে দেখা একান্ত প্রয়োজন। রাষ্ট্রের সেবা খাত হিসেবে এবং জনগণের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ, সস্তা ও পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবে রেলওয়েকে সব সময় লাভজনক হতেই হবে, এমন হয়তো কোনো কথা নেই। কিন্তু জনগণকে সেবা দিয়েও যে রেলওয়ে লাভজনক হতে পারে, সে দৃষ্টান্ত প্রতিবেশী দেশ ভারতেই দেখা যায়। বাংলাদেশেও তা সম্ভব, যদি রেলওয়ে খাতের অপচয়, দুর্নীতি ও লোপাট বন্ধ করা হয়, যদি রেলওয়ের মালিকানাধীন জমি ও সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হয়, যদি রেলওয়ের অবকাঠামো উন্নয়নে ধারাবাহিক, পরিকল্পিত ও সমন্বিত বিনিয়োগ করা হয়। বিভিন্ন ধরনের যাত্রীবাহী কোচের কম্বিনেশন, কোচের যাত্রী ধারণক্ষমতা এবং কোচের সিটের কত শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে তার হার ইত্যাদির ওপর ট্রেনপ্রতি আয় নির্ভর করে। ফলে যেসব রুটের ট্রেন জনপ্রিয় এবং কোচগুলো সব সময় যাত্রীবোঝাই হয়ে চলে, সেসব রুটের ট্রেনে কোচসংখ্যা বাড়ানো হলে আয় বৃদ্ধি পায়। একসময় লোকসানে থাকা ভারতীয় রেলওয়ে এভাবে কোচপ্রতি ও ট্রেনপ্রতি আয় বাড়িয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে চাহিদা ও জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও সে অনুসারে রেলের আয় বাড়ছে না। যেমন: ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের সুবর্ণ এক্সপ্রেস, মহানগর এক্সপ্রেস, সোনার বাংলা, তূর্ণা-নিশিথাসহ ট্রেনগুলোর ২২টি বগি নিয়ে চলাচল করার ক্ষমতা থাকলেও চালানো হয় ১২-১৬ বগি নিয়ে। একসময় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে দুটি ট্রেন দিনে ৩২ বার যাতায়াত করলেও ইঞ্জিন ও কোচের সংকটে একটি ট্রেন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা দিনে ১৬ বার যাতায়াত করে। অথচ এই পথে ট্রেনের চাহিদা এত বেশি যে দিনে শতবার যাতায়াত করলেও যাত্রীর অভাব হবে না। এই চিত্র সারা দেশের। রেলের সব কটি ট্রেন নিরবচ্ছিন্নভাবে চালাতে হলে দরকার ৩ হাজারের বেশি কোচ আর প্রায় ৫০০ ইঞ্জিন। কিন্তু রেলে বর্তমানে কোচ আছে ১ হাজার ৬৮৪ যার ৪৭ শতাংশেরই মেয়াদকাল শেষ। আর ইঞ্জিনের সংখ্যা মাত্র ২৬৩, যার ৬৭ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ। এই জীর্ণ-পুরোনো ইঞ্জিন ও কোচগুলো প্রায়ই নষ্ট থাকায় সব সময় কাজে লাগানো যায় না। ইঞ্জিন ও কোচের এই তীব্র সংকটের কারণে খাতা-কলমে ৩৬৮টি ট্রেন থাকলেও বাস্তবে চলছে মাত্র ২৭৬টি। এভাবে অনেক রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ করা বা কমিয়ে দেওয়া এবং চলমান ট্রেন গুলোও সক্ষমতার চেয়ে কম কোচ নিয়ে চলাচলের কারণে রেলপথপ্রতি ও রেলপ্রতি আয় কম হচ্ছে। ফলে বর্তমানে ট্রেন পরিচালনায় প্রত্যেক যাত্রীর পেছনে কিলোমিটার প্রতি প্রায় আড়াই টাকা ব্যয়ের বিপরীতে আয় হয় তার অর্ধেক। শুধু যাত্রী পরিবহনে রেলকে লাভজনক করা যায় না, মালামাল পরিবহনে গুরুত্ব দিতে হবে। মালবাহী ট্রেন যাত্রীবাহী ট্রেনের তুলনায় বেশি ভার বহন করলেও উভয়ে একই ড্রাইভার, রেললাইন, সিগন্যাল ব্যবস্থা ইত্যাদি ব্যবহার করে। ফলে একটি মালবাহী ট্রেন পাঁচ গুণ ভার বহন করলেও খরচ যাত্রীবাহী ট্রেনের তুলনায় দ্বিগুণের কম হয়। তা ছাড়া ভারী পণ্য বিপুল পরিমাণে একত্রে পরিবহনের সক্ষমতা থাকলেও সেই সুবিধানজনক অবস্থানকে কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ রেলওয়ে। ভারতীয় রেলের মোট আয়ের ৭০ শতাংশের বেশি আসে পণ্য পরিবহন থেকে এবং যাত্রী পরিবহনে যে খরচ হয়, গড়ে তার ৪৩ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হয় পণ্য পরিবহনের আয় থেকে। অন্যদিকে বাংলাদেশ রেলওয়ের আয়ের মাত্র ২১ শতাংশ আসে পণ্য পরিবহন থেকে। সড়কের চেয়ে খরচ কম হলেও রেলে সময় লাগে বেশি। ফলে দেশের মোট কনটেইনারের মাত্র ৩ শতাংশ পরিবহন হয় রেলওয়ের মাধ্যমে। তুলনামূলক ভাবে বেশি প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে থাকা ক্ষেত্র গুলোতে ভাড়া কিছুটা বাড়িয়ে এবং যেসব ক্ষেত্র দুর্বল অবস্থানে রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে পণ্যের ভাড়া কিছুটা কমিয়ে হারানো বাজার পুনরুদ্ধার করে মালামাল পরিবহন অধিক লাভজনক করেছে ভারতীয় রেলওয়ে আবার যেসব রুটে মালবাহী বগিগুলোকে খালি ফিরতে হয়, সেগুলোতে মালামাল পরিবহনে আকর্ষণ করতে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়েছে। যদিও সরবরাহব্যবস্থায়ও নানা পদক্ষেপ নিয়ে দ্রুততর, দীর্ঘতর ও অপেক্ষাকৃত ভারী ট্রেন চালানোর মাধ্যমে প্রতি একক খরচ কমানো হয়েছে। রেল খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের পরও সংকট কাটছে না। অপর্যাপ্ত ও মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন ও কোচ, পুরোনো ও জীর্ণ রেললাইন এবং ঝুঁকিপূর্ণ সেতু, ধীরগতি আর চাহিদা অনুযায়ী টিকিট না পাওয়ার অভিযোগের মধ্যেই লোকসান গুনে চলেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। গত অর্থবছরে রেলের পরিচালন ব্যয় ৩ হাজার ৭৬২ কোটি, বিপরীতে আয় ১ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। লোকসান ২ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। ২০১২ ও ২০১৬ সালে দুই দফায় রেলের ভাড়া বাড়ানো হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। কারণ, আয় বাড়ানোর জন্য ভাড়া বাড়ানোই একমাত্র বা সঠিক উপায় নয়। এর জন্য ট্রেনপ্রতি আয় বাড়াতে হবে ও ব্যয় হ্রাস করতে হবে। কোনো পদক্ষেপের পেছনে যদি সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকে তাহলে তাতে অর্থেরই কেবল অপচয় হয় না, এর সুফলও পায় না জনগণ। বাংলাদেশ রেলওয়ের হয়েছে সেই দশা। গত এক যুগে নতুন রেলপথ ও স্টেশন ভবন নির্মাণ, সিগন্যালিং ব্যবস্থার আধুনিকায়নসহ বিভিন্ন খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেছে সরকার। দুঃখজনকভাবে এত বিনিয়োগ সত্ত্বেও যাত্রীসেবার মান বাড়েনি। শিডিউল বিপর্যয়, দুর্ঘটনা, অবকাঠামোগত দুর্বলতার বিষয়গুলো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সংস্থাটি। এর অর্থ হচ্ছে, যে লক্ষ্য নিয়ে বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা অর্জিত হয়নি। মূলত সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণেই রেলওয়ের জটিলতা পিছু ছাড়ছে না। অভিযোগ রয়েছে, প্রয়োজনীয় প্রকল্পের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের কারণেই যাত্রীসেবার মান বাড়ছে না। বেশির ভাগ প্রকল্প নেয়া হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। কোন কাজটি আগে করতে হবে, কোনটি পরে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হচ্ছে না। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে গণপরিবহনের সবচেয়ে সুবিধাজনক ও কার্যকর মাধ্যম হতে পারত রেল পরিবহন, কিন্তু তা হয়নি। সমস্যাগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে সমাধানের কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয় না; যা কিছু চেষ্টা করা হয়, তাও ফলপ্রসূ হয় না। এ অবস্থার উত্তরণে রেলওয়ের উচিত যাত্রীসেবার মান বাড়ানোর বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়া। রেল ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। সরকারকে খুঁজে দেখতে হবে তারা কী লক্ষ্য অর্জনে রেলে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। সেই লক্ষ্য কি অর্জিত হয়েছে? হলে কতটা তাও মূল্যায়ন করতে হবে বিপন্ন সড়ক ব্যবস্থাপনাই হয়তো সাম্প্রতিক সময়ে রেলের দিকে মানুষের নজর ঘুরিয়েছে। জনসংখ্যা বাড়ছে; দেশের অর্থনীতির আকার ও অন্তর্গত শক্তিও বাড়ছে জোর কদমে। সমাজে এর প্রতিফলন স্পষ্ট। নাগরিকের জীবনমান পাল্টে যাচ্ছে। উন্নত, স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপন এখন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক সংস্কৃতি। সামাজিক চাহিদার এ রূপান্তর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, কৃষির পাশাপাশি যোগাযোগের মতো অত্যাবশ্যক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর নির্ভরযোগ্যতা ও নিরাপত্তার প্রশ্নকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলছে। ভাবনার এ বৃত্তে গণপরিবহন হিসেবে রেলের গ্রাহ্যতা ক্রমেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট । ডেল্টা টাইমস্/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |